প্রশ্ন- মোহিতলাল মজুমদারের 'অঘোরপন্থী' কবিতায় বর্ণিত
'অঘোরপন্থী'র জীবনদর্শন কী? তিনি প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে কীভাবে দেখেন
এবং কেন তা প্রত্যাখ্যান করেন?
মোহিতলাল মজুমদারের
'অঘোরপন্থী' কবিতাটি কেবল একটি চরিত্র বর্ণনা নয়, বরং এটি একটি গভীর জীবনদর্শন ও
প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতিকে প্রত্যাখ্যানের এক সাহসী ঘোষণা। কবিতায় বর্ণিত
'অঘোরপন্থী' কোনো সাধারণ মানুষ নন, তিনি এমন এক সত্তা যিনি সমাজের প্রতিষ্ঠিত
মূল্যবোধ, ভয়, লজ্জা ও শুচিতা-অশুচিতার ধারণাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজস্ব এক
জীবনবোধে বিশ্বাসী।
'অঘোরপন্থী'র
জীবনদর্শনের মূল ভিত্তি হলো নির্ভয়তা এবং চরম নির্লিপ্ততা। তিনি পার্থিব কোনো
আকর্ষণ, যেমন - ধনসম্পদ, খ্যাতি, সম্মান বা ভালোবাসার দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত
নন। তাঁর কাছে জীবন ও মৃত্যু একাকার; শ্মশানভূমিই তাঁর বিচরণক্ষেত্র, যেখানে
মৃতদেহ, হাড়গোড় ও ভস্ম তাঁর নিত্যসঙ্গী। এই অনুষঙ্গগুলো ভয় বা বিতৃষ্ণা তৈরি
করার বদলে তাঁর কাছে জীবনের এক স্বাভাবিক অংশ। তাঁর এই নির্লিপ্ততা কেবল বাহ্যিক
নয়, এটি তাঁর অন্তর্গত দর্শন—সবকিছুকে গ্রহণ করার এবং কোনো কিছুতেই আসক্ত না
হওয়ার এক গভীর প্রত্যয়। এই দর্শন তাঁকে জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত করে এক চরম
স্বাধীনতার পথে নিয়ে যায়।
তিনি প্রচলিত
সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রত্যাখ্যানের
কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:
প্রথমত,
'অঘোরপন্থী'র কাছে সমাজের নিয়মকানুনগুলো কৃত্রিম ও অর্থহীন। সমাজ যে শুচিতা,
পবিত্রতা বা নৈতিকতার ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেছে, তা তাঁর কাছে এক ধরনের ভণ্ডামি।
তিনি শ্মশানে থাকেন, মৃতদের নিয়ে তাঁর কোনো ঘৃণা নেই, যা সমাজের চোখে অশুচি ও
অগ্রহণীয়। এই আচরণ প্রচলিত রীতির প্রতি তাঁর চরম বিতৃষ্ণা ও বিদ্রোহের প্রকাশ।
তিনি মনে করেন, সমাজের তথাকথিত ভদ্রতা ও সংযম মানুষকে তার প্রকৃত সত্তা থেকে দূরে
সরিয়ে রাখে এবং এক মিথ্যা জীবনযাপনে বাধ্য করে।
দ্বিতীয়ত,
তিনি ভয়-ভীতির বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চান। সমাজ মানুষকে অসংখ্য ভয়ের বেড়াজালে
আটকে রাখে - মৃত্যুর ভয়, লোকনিন্দার ভয়, অকৃতকার্যতার ভয়। 'অঘোরপন্থী' শ্মশানে
বিচরণ করে, মৃতদেহের সঙ্গে সময় কাটিয়ে এবং প্রচলিত লোকাচার উপেক্ষা করে এই সকল
ভয়কে জয় করেছেন। তাঁর কাছে ভুত-প্রেত বা মৃত্যুর কোনো অস্তিত্ব নেই, কারণ তিনি
জীবনের চরম সত্যকে মেনে নিয়েছেন। এই নির্ভয়তাই তাঁকে প্রচলিত সমাজের ভীরুতা ও
দ্বিচারিতা থেকে আলাদা করে।
তৃতীয়ত,
'অঘোরপন্থী' জাগতিক আকাঙ্ক্ষা ও ভোগবাদের ঊর্ধ্বে উঠেছেন। সমাজের মূল চালিকা শক্তি
হলো ভোগ ও আকাঙ্ক্ষা। মানুষ বস্তুগত প্রাপ্তির পেছনে ছুটে বেড়ায়, যা তাকে অবিরাম
এক মানসিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেয়। 'অঘোরপন্থী' এই সকল লোভ-মোহ থেকে মুক্ত। তাঁর
কোনো ঘরবাড়ি নেই, কোনো পরিবার নেই, কোনো জাগতিক সম্পত্তির প্রতি তাঁর আকর্ষণ নেই।
এই বৈরাগ্য তাঁকে এক প্রকার আধ্যাত্মিক মুক্তি দেয়, যা সমাজের ক্ষুদ্র
আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করে সম্ভব নয়।
চতুর্থত,
তাঁর প্রত্যাখ্যানের মূলে রয়েছে আত্মানুসন্ধান ও প্রকৃত সত্যের অন্বেষণ। তিনি
প্রচলিত পথের বাইরে গিয়ে নিজের মতো করে জীবনের অর্থ খুঁজে নিতে চান। সমাজের
আরোপিত নিয়মগুলো তাঁর কাছে সত্যের পথ নয়, বরং তা একরকম বিভ্রম। তিনি মনে করেন,
সমাজের এই ভণ্ডামিপূর্ণ আবরণ ছিঁড়ে ফেললেই জীবনের প্রকৃত রূপ দেখা যায়। শ্মশান
তাই কেবল একটি স্থান নয়, এটি তাঁর আত্মিক মুক্তির এক সাধনক্ষেত্র।
সংক্ষেপে,
মোহিতলাল মজুমদারের 'অঘোরপন্থী' প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে
প্রত্যাখ্যান করেন কারণ তিনি সেগুলোকে কৃত্রিম, ভয়-ভিত্তিক এবং জীবনের প্রকৃত
অর্থ উপলব্ধিতে বাধা বলে মনে করেন। তাঁর জীবনদর্শন নির্ভয়তা, নির্লিপ্ততা এবং
জাগতিক বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, যা তাঁকে সমাজের বেঁধে দেওয়া
গণ্ডির বাইরে এক চরম স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যায়। তিনি যেন এক চরম বিদ্রোহী, যিনি
সমাজের চাপানো মিথ্যা মুখোশকে ছিঁড়ে ফেলে সত্যের উন্মোচন ঘটাতে চান।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।