প্রশ্নঃ ‘শাস্তি’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
নিসর্গের ভাঙাগড়াময়
দুর্বোধ্য পটক্ষেপে রচিত 'শাস্তি' গল্পটি একটি অসরল প্রেমের বিয়োগান্ত কাহিনি। চন্দরা
ও ছিদামের প্রেমের মর্মমূলে বাসা বেঁধেছে পারস্পরিক অবিশ্বাস। তার কারণ থাকলেও তা যে
নিতান্তই অমূলক এবং অনেকাংশে উভয়ের স্বরচিত, তাতে নেই কোন সন্দেহের অবকাশ। তার মধ্যস্বতায়
উভয়েই উভয়ের হৃদয়ে বিস্তার করতে চেয়েছে আপন আপন একচ্ছত্র প্রেমের সাম্রাজ্য। অথচ উভয়ের
হৃদয়ের সিংহাসনে উভয়েই ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। সেই সংবাদটুকুই উভয়ের ছিল অজ্ঞাত। এইখানেই
তাদের ট্র্যাজেডি। তাই অবিশ্বাস, সংশয় এবং সংঘাত। এবং তাই-ই তাদের প্রেম জীবনের নিয়তি।
নিরপরাধা, অথচ চঞ্চলা, কৌতুকপ্রবণা, যৌবনবতী অবাধ্য চন্দরাকে বশীভূত করবার জন্য পারিবারিক
দুর্ঘটনায় মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে সাময়িক শাস্তি দান করে তাকে সুকৌশলে মুক্ত করে আনার
পরিকল্পনা করেছে ছিদাম। কিন্তু চন্দরা স্বামী প্রদত্ত সেই শাস্তিকে প্রবল অভিমানে তার
প্রেমের প্রতি চরম অসম্মান মনে গ্রহণ করেছে মনে-প্রাণে এবং তার ফলে, হৃদয় খেলায় অনভিজ্ঞ
ছিদামকে সে চিরজীবনের মতো দিয়ে গেছে কঠোরতম শাস্তি।
পদ্মা তীরবর্তী গ্রামের
দুখিরাম বুই ও ছিদাম বুই যুগল ভ্রাতা জমিদারের কোর্ফা প্রজা। তাদের কয়েক বছরের খাজনা
বাকী। ঘরে অন্নাভাব, তার ওপর জমিদারের পেয়াদা এসে সকালেই যুগল ভ্রাতাকে জবরদস্তি করে
ধরে নিয়ে যায় কাছারিবাড়ির চালের মেরামতির জন্য। সারাদিন তাদের কপালে জোটে দ্বিপ্রাহরিক
আহারের পরিবর্তে সামান্য জলপান এবং অজস্র অন্যায় কটুক্তি। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের
পর সামান্য মজুরী নিয়ে ক্ষুধার্ত অবসন্ন শরীরে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে দুখিরাম ভাত চেয়ে
স্ত্রীর ক্রুদ্ধ কন্ঠ-ঝঙ্কারে দিক্-বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে তার মাথায় বসিয়ে দেয় দায়ের
কোপ। তাতে মৃত্যু ঘটে তার স্ত্রীর রাধার। বাড়িতে কোনোদিনই তাদের শান্তি ছিল না। বড়ো
বউ রাধা ও ছোটো বউ চন্দরার মধ্যে প্রতিদিনই বিবাদ লাগত।
ছিদাম ও চন্দরার প্রেমের
অন্তর্ঘাত শাস্তি গল্পের নিষ্ঠুর পরিনাম। যদিও চন্দরার প্রতি ছিদামের ভালোবাসার গভীরতা
সম্পর্কে সে ছিল নিঃসংশয়, তবু অন্য কোন গ্রামবধূর প্রতি ছিদামের দুর্বলতা তার পক্ষে
ছিল অসহ্য। তাই স্বামী দেবতাটিকে সম্পূর্ণ অধিকার করে তার হৃদয়ে পূর্ণ আধিপত্য বিস্তারের
জন্য সে ছিল নিরলস প্রয়াসী। অন্যদিকে চঞ্চলাস্বভাবা চন্দরার প্রতি ছিদাম ছিল সন্দিগ্ধচিত্ত।
এমনসময় গৃহে ঘটে সেই সাংঘাতিক দুর্ঘটনা। দুখিরাম ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তার বউকে খুন
করে বসে। স্বভাবতঃই, ঘটনাটির আকস্মিকতায় এবং ভয়াবহতায় সকলেই হয়ে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সত্যমিথ্যার টানাপোড়েনে দিশেহারা হয়ে ভাইকে বাঁচাবার জন্যে ছিদাম রামলোচন চক্রবর্তীর
কাছে মিথ্যা প্রকাশ করে ফেলে যে চন্দরাই রাধাকে খুন করেছে। রামলোচন চক্রবর্তী ছিদামকে
পরামর্শ দিয়েছে দুখিরামের ঘাড়ে অপরাধের সমস্ত দায়ভাগ চাপিয়ে দিয়ে নিজের স্ত্রীকে বিপদমুক্ত
করতে। ছিদাম তার জবাবে বলেছে "ঠাকুর বউ গেলে বউ পাইব, কিন্তু আমার ভাই ফাঁসি গেলে
তো আর ভাই পাইব না।' ছিদামের এই কঠোর মন্তব্যে প্রেম-সর্বস্বা চন্দরার হৃদয় বিধ্বস্ত
হয়েছে। স্বামী তাকে বাঁচাবার জন্য কোর্টে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে। চন্দরা সকল দুঃখের
উর্ধ্বে উঠে সে জীবন সম্পর্কে হয়ে গেছে নির্মোহ-উদাসীন। তাই শান্ত কণ্ঠে পুলিশের কাছে
সে স্বীকার করেছে অপরাধ। সে ফাঁসিকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। সে স্বেচ্ছায় হাসিমুখে শাস্তি
গ্রহণ করে শাস্তি দিয়ে গেছে তার স্বামী ছিদামকে। এই দিক থেকে বিচার করলে শাস্তি গল্পের
নামকরণ যে সার্থক তা বোঝার আর কোন অবকাশ থাকে না।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।