প্রশ্ন- পরবর্তী বৈদিক যুগে বিবাহের প্রকারগুলি কী কী?
পরবর্তী
বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ - খ্রিস্টপূর্ব ৬০০) সামাজিক কাঠামোতে ব্যাপক
পরিবর্তন আসে, এবং এর প্রভাব বিবাহ প্রথার উপরেও পড়ে। ঋগ্বৈদিক যুগের সরল বিবাহ
প্রথা পরিবর্তিত হয়ে আট প্রকারের বিবাহ প্রথা প্রচলিত হয়, যা মনুস্মৃতি ও
অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে উল্লিখিত আছে। এই আট প্রকার বিবাহকে প্রধানত দুটি শ্রেণীতে
ভাগ করা যায়: 'প্রশংসনীয়' বা 'বৈধ' বিবাহ (ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী)
এবং 'নিন্দনীয়' বা 'অবৈধ' বিবাহ (যেগুলি সামাজিক বা ধর্মীয় অনুমোদন পেত না)।
Ø
প্রশংসনীয়/বৈধ বিবাহ:
১. ব্রহ্ম বিবাহ: এটি ছিল সবচেয়ে উচ্চ এবং
সম্মানিত বিবাহ প্রথা। এতে মেয়ের বাবা একজন যোগ্য, শিক্ষিত এবং সচ্চরিত্র পাত্রকে
আমন্ত্রণ জানিয়ে তার মেয়ের সাথে বৈদিক রীতিতে বিবাহ দিতেন। এই বিবাহে সাধারণত পণ
বা যৌতুকের কোনো লেনদেন থাকত না, বরং কন্যাকে অলংকার ও উপহার দিয়ে সম্মানিত করা
হতো। এটি একই বর্ণের মধ্যে সম্পন্ন হতো এবং পাত্র-পাত্রীর যোগ্যতা ও সদ্ব্যবহারের
উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। ব্রহ্ম বিবাহকে ধর্মীয় ও সামাজিক উন্নতির সহায়ক
বলে মনে করা হতো।
২. দৈব বিবাহ: এই প্রথায় মেয়ের বাবা তার
মেয়েকে একজন পুরোহিতের সাথে বিবাহ দিতেন, যিনি কোনো যজ্ঞ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে
অংশগ্রহণ করতেন এবং যাগযজ্ঞের দক্ষিণা হিসেবে এই কন্যাকে প্রদান করা হতো। যেসব
কন্যার বিবাহ হচ্ছিল না, তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় এই প্রথা অবলম্বন করা হতো। এটি
ধর্মীয় আচারের অংশ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় সম্মানজনক বলে গণ্য হতো, যদিও এতে কন্যার
নিজস্ব ইচ্ছার তেমন গুরুত্ব থাকত না।
৩. আর্ষ বিবাহ: এই প্রথায় বর কনের পিতাকে
এক জোড়া গরু ও ষাঁড় দান করে কন্যাকে বিবাহ করত। এটিকে কন্যার মূল্য হিসেবে দেখা
হতো না, বরং ধর্মীয় আচারের অংশ হিসেবে একটি প্রতীকী দান হিসেবে ধরা হতো। এর
মাধ্যমে কনেপক্ষকে সম্মান জানানো হতো এবং মনে করা হতো যে এই দান কন্যার পরিবারকে
কৃষিকাজে সাহায্য করবে। এটিও প্রশংসনীয় বিবাহের মধ্যে গণ্য হত।
৪. প্রাজাপাত্য বিবাহ: এই বিবাহ প্রথা ব্রহ্ম বিবাহের
মতোই ছিল, তবে এখানে কন্যা সম্প্রদানকালে কনের পিতা পাত্র-পাত্রীকে "তোমরা
দুজনে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করো" বলে শুভ কামনা করতেন। ব্রহ্ম বিবাহের মতো
এখানেও পণ বা যৌতুকের বিষয় থাকত না, তবে পাত্র বা পাত্রীর যোগ্যতা যাচাইয়ের
ক্ষেত্রে ব্রহ্ম বিবাহের মতো কঠোর নিয়ম ছিল না। এই বিবাহে মূলত ধর্ম পালনের
উদ্দেশ্যে একটি সামাজিক বন্ধন তৈরি করা হতো।
Ø
নিন্দনীয়/অবৈধ বিবাহ:
৫. গন্ধর্ব বিবাহ: এটি ছিল মূলত প্রেমের বিবাহ,
যেখানে পাত্র-পাত্রী একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়াই বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হতো। এটি বর্তমানের "প্রেম বিবাহ" এর মতো। এই বিবাহে কোনো
ধর্মীয় আচার বা রীতি তেমনভাবে মানা হতো না। যদিও এই বিবাহে পারস্পরিক ভালোবাসা ও
সম্মতি ছিল, তৎকালীন সমাজে এটিকে নিন্দনীয় বা অন্তত কম সম্মানজনক বলে মনে করা
হতো, কারণ এতে পরিবারের সম্মতি ও সামাজিক রীতিনীতি লঙ্ঘিত হতো। মহাভারত ও অন্যান্য
পুরাণে এই ধরনের বিবাহের অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের
ইচ্ছামত বিবাহ করত।
৬. আসুর বিবাহ: এই প্রথায় বর কনেপক্ষকে
অর্থ বা সম্পত্তি দিয়ে কন্যাকে ক্রয় করত। এটি অনেকটা বাণিজ্যিক চুক্তির মতো ছিল,
যেখানে কন্যার সম্মতি বা ইচ্ছার কোনো মূল্য ছিল না। কন্যার পরিবারের আর্থিক
অবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই ধরনের বিবাহ সম্পন্ন হতো। সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে
এই বিবাহকে অসম্মানজনক ও নিন্দনীয় বলে গণ্য করা হতো।
৭. রাক্ষস বিবাহ: এটি ছিল এক ধরণের জবরদস্তি
বা অপহরণের মাধ্যমে বিবাহ। বর জোর করে বা যুদ্ধ করে কন্যাকে অপহরণ করে বিবাহ করত।
বিশেষত ক্ষত্রিয়দের মধ্যে এই ধরনের প্রথা প্রচলিত ছিল, যেখানে বীরত্ব প্রদর্শনের
অংশ হিসেবে কন্যা অপহরণ করে বিবাহ করা হতো। যদিও কিছু ক্ষেত্রে এটিকে বীরত্বের
প্রতীক হিসেবে দেখা হতো, সামগ্রিকভাবে এটি অমানবিক ও নিন্দনীয় প্রথা হিসেবে
চিহ্নিত ছিল।
৮. পৈশাচ বিবাহ: এটি ছিল বিবাহের সবচেয়ে
জঘন্য ও নিন্দনীয় রূপ। এই প্রথায় একজন পুরুষ কোনো অজ্ঞান, উন্মাদ, নিদ্রিত,
মদ্যপ বা মানসিকভাবে অসুস্থ নারীকে জোরপূর্বক বা প্রতারণা করে তার অজান্তেই বিবাহ
করত বা তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করত। এটি নারী সম্ভ্রমের চরম লঙ্ঘন ছিল এবং সমাজ
এই প্রথাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করত।
পরবর্তী
বৈদিক যুগে এই আট প্রকারের বিবাহ প্রথা তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। এর
মাধ্যমে একদিকে যেমন ধর্মীয় ও সামাজিক আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হয়েছে,
তেমনই অন্যদিকে সামাজিক দুর্বলতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রও ফুটে উঠেছে। এই বিবাহ
প্রথাগুলো বর্ণপ্রথা, নারীর সামাজিক অবস্থান এবং সম্পত্তির ধারণার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে
জড়িত ছিল। সামগ্রিকভাবে, পরবর্তী বৈদিক যুগে বিবাহ প্রথা আরও সংগঠিত এবং
শ্রেণীবদ্ধ হয়েছিল, যা সমাজে ক্রমবর্ধমান জটিলতার প্রতিফলন ঘটায়।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।