ডাকঘর নাটকে অমলের চরিত্র আলোচনা কর।

Nil's Niva
0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ডাকঘর' নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র পাঁচ বছর বয়সী অমল, এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বালক। নাটকের প্রেক্ষাপট ঠাকুরদাদার বাড়িতে তার বন্দি জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। শারীরিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অমল এক অসাধারণ মানসিক শক্তির অধিকারী। তার কৌতূহলী মন, অদম্য কল্পনাশক্তি এবং বাইরের মুক্ত পৃথিবীর প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে নাটকের এক স্বতন্ত্র ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্রে উন্নীত করে।

শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও অমল প্রাণশক্তিতে ভরপুর। জানালার পাশে বসে বাইরের জগতের সামান্যতম দৃশ্যও তার কৌতূহল উদ্রেক করে। সে পথের ধারের হাঁটাচলা করা মানুষ, দইওয়ালা, ফুলওয়ালী, প্রহরী - সকলের জীবন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। এই আগ্রহ তার বন্দি জীবনের একঘেয়েমি দূর করে এবং তার কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করে। অমলের প্রশ্নগুলি সরল হলেও গভীর ভাবনার দ্যোতক। "তুমি কোথা থেকে এসেছ?", "রাজার চিঠি কেমন হয়?" - এই ধরনের জিজ্ঞাসার মাধ্যমে সে যেন এক অদেখা রহস্যময় জগতের সন্ধান করে ফেরে।

অমল চরিত্রে স্বপ্নালুতা এবং বাস্তবতাবোধের এক সুন্দর মিশ্রণ দেখা যায়। সে রাজার আগমন এবং তার কাছ থেকে একটি চিঠির প্রত্যাশায় বিভোর থাকে। এই চিঠি তার কাছে কেবল এক টুকরো কাগজ নয়, বরং বন্দি জীবন থেকে মুক্তির এবং এক নতুন, আনন্দময় জগতে প্রবেশের ছাড়পত্র। সে রাজার দূত হওয়ার স্বপ্ন দেখে, দূরের দেশে ঘুরে বেড়ানোর কল্পনা করে। তবে একইসাথে, সে তার শারীরিক দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন এবং ঠাকুরদাদার স্নেহপূর্ণ শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

অমল চরিত্রে নিঃসঙ্গতা এবং যোগাযোগের তীব্র আকাঙ্ক্ষা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বন্দি জীবনে তার খেলার সাথী নেই, তাই বাইরের জগতের যে কোনো মানুষের সামান্য মনোযোগও তার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। দইওয়ালা, ফুলওয়ালী বা প্রহরীর সাথে তার ক্ষণিকের কথোপকথনগুলি তার একাকীত্ব দূর করার এবং বাইরের পৃথিবীর সাথে সংযোগ স্থাপনের আকুলতার প্রকাশ। এই চরিত্রগুলির সাথে তার আন্তরিক ও সরল ব্যবহার তার মানবিক গুণাবলীকে ফুটিয়ে তোলে।

অমল চরিত্রে এক গভীর আধ্যাত্মিক চেতনাও বিদ্যমান। তার শান্ত ও গভীর চাহনি, রাজার প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং মৃত্যুর প্রতি তার ভীতিহীন মনোভাব - এগুলি তার মধ্যে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক দ্যোতনা সৃষ্টি করে। রাজার চিকিৎসকের আগমন এবং তার "ভয় নেই, ভয় নেই" - এই শান্ত আশ্বাস অমলের আসন্ন প্রস্থানকে এক বিষণ্ণ অথচ শান্তিময় পরিণতি দান করে। মনে হয় যেন অমল জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে এক বৃহত্তর, শান্তিময় জগতে যাত্রা করেছে।

নাটকের নামকরণেও অমলের প্রতীক্ষার তাৎপর্য বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। 'ডাকঘর' অমলের কাছে সেই স্থান, যেখান থেকে রাজার অপ্রত্যাশিত বার্তা তার বন্দি জীবনে মুক্তির আনন্দ নিয়ে আসতে পারে। যদিও বাস্তবে সেই চিঠি কখনোই আসে না, তবুও অমলের প্রতীক্ষা তার ভেতরের এক গভীর বিশ্বাস এবং অদম্য আশাকে ফুটিয়ে তোলে। এই প্রতীক্ষা কেবল জাগতিক মুক্তির নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক মুক্তিরও ইঙ্গিত বহন করে।

পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর' নাটকে অমল কেবল একটি অসুস্থ শিশুই নয়, বরং সে মানব হৃদয়ের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা, বন্দি জীবন থেকে মুক্তির স্বপ্ন এবং এক অদেখা রহস্যময় জগতের প্রতীকরূপে উপস্থাপিত হয়। তার সরলতা, কৌতূহল, স্বপ্নালুতা এবং গভীর আধ্যাত্মিক চেতনা তাকে নাটকের এক অবিস্মরণীয় চরিত্রে পরিণত করেছে। অমলের বন্দি জীবন এবং রাজার চিঠির প্রতীক্ষা নাটকের মূল সুর - আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির এক করুণ অথচ গভীর চিত্রায়ণ। অমল চরিত্রটি নাটকের ভাববস্তুকে এক নতুন মাত্রা দান করে এবং দর্শকের মনে গভীর সহানুভূতি ও চিন্তার উদ্রেক করে।        

জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার

তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি

অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।

Tags

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
bookstore