প্রশ্ন- গণনাট্য সম্বন্ধে যা জান লেখো।
*****************************************
উত্তরঃ গণনাট্য বা গণনাট্য সংঘ হল ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী একটি নাট্যদল যেটি ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে গণনাট্য আন্দোলন শুরু করেছিল বাংলার গ্রামীণ জনপদে সামাজিক ও রাজনৈতিক নাটকের প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে। গণনাট্য মূলতঃ সমাজতান্ত্রিক "ভাবধারার নাট্যকর্মীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠায় এটির মূল লক্ষ্য ছিল তৃণমূল স্তরের গণমানুষকে নাট্যকলার মাধ্যমে সচেতন করে নিজেদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলতেন সম্পৃক্ত করা। গণনাট্য আন্দোলন বাংলার নাট্যসাহিত্যের উপর প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি এখানকার জনমানসে সাংস্কৃতিক বিকাশও সাধন করেছে।
১৯৪৪ সালটা ছিল বাংলার সাধারণ রঙ্গালয়েরে পুরোধা পুরুষ গিরিশচন্দ্রের জন্ম তোমা ওই বছরেই প্রথম অভিনীত হয়েছিল সাধারণ র্যালয়েরে পুরোয়াল্যাণে নাট্যামোদীদের হৃদয়ে প্রোথিত হল গণনাট্যর শিকড়; আর সেই আবির্ভাব আহলে বালো নাটকের মূল ধারাটির মুখ ঘুরিয়ে দিল সাধারণ রঙ্গালয়ের বাইরে।
কিন্তু, একটু বাড়িয়ে ধরলেও গণনাট্য আন্দোলনের আলো বিচ্ছুরিত হয়েছিল মাত্রা বছর দশেক, ১৯৪৩ থেকে '৫২। কেন এমন হল তা নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। কেউ জোর দিয়েছেন স্বাধীনতাউত্তর শাসক গোষ্ঠীর কম্যুনিস্ট প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে দমন নীতির উপর। কেউবা গণনাট্য স্তিমিত হয়ে যাওয়ার দায় চাপিয়েছেন কম্যুনিস্টদের কাঁধেই। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের ব্যবহার করার বদলে তাঁদের উপর পার্টি লাইন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই নাকি বিমুখ করেছিল শিল্পীদের। ভাঙনের কারণ যাই হোক কেন, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, গণনাট্য ছিল সময়ের ফসল। পরিবর্তিত সময়ই তাকে মুছে দিয়েছে। প্রত্যাগমন করেছে নবনাট্যর তথা গল্প থিয়েটার আন্দোলনের।
আসলে সমাজে যখন বিশিষ্ট রকমের নাট্য প্রয়োগের পরিবেশ, আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখনই নতুনতর নাটক লেখা হতে পারে। অন্তত বাংলা নাটকের দিকে তাকালে তাই মনে হয়। ইংরেজের থিয়েটার দেখে, স্কুল কলেজে শ্রেষ্ঠ ইংরেজি নাট্যে অভিনয় করে, উন্নত বুর্জোয়া চিন্তা চেতনার ছিটেফোঁটা স্পর্শ পেয়ে, উন্নত বাহালি ভাল নাটকের জন্য উন্মুখ হয়েছিল। সেই জন্যই রামনারায়ণের পরে সম্ভব হয়েছিল মধুসুদনের উত্থান।
'নীলদর্পনের সফল অভিনয় বুঝিয়ে দিয়েছিল, প্রথম সাধারণ রণালয়ের কাছে মানুষের তীব্র রাজনৈতিক প্রত্যাশা আছে। অতঃপর সেই পথে আলো জ্বালিয়েছিল উপেন্দ্রনাথের নাটকগুলি। থিয়েটারে দর্শকের ঢল, সুশিক্ষিত অভিনেতৃমণ্ডলী উপস্থিত, অথচ কাঁধে সরকারি নিয়ন্ত্রণের থাবা-এই অবস্থা থেকেই বেরিয়ে এসেছিল গিরিশচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ পৌরাণিক নাটকগুলি, যা পুরাতন নয় বরং সমকালীন মানুষের কথাই বলতে চায়। শিশির ভাদুড়ির উপস্থিতি সত্ত্বেও সাধারণ রঙ্গালয়ের গৌরব-রবি কখন অস্তমিত, ভাল নাটকের এভাবে তিনি দুঃখ করেছেন, তখনই লেখা হয়েছিল 'নবান্ন'। বিজন যদি কম্যুনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে না আসতেন, পার্টির ছত্রতলে সে সময়ের সেরা শিল্প ব্যক্তিত্বরা যদি জমায়েত না হতেন, গণনাট্যর আওয়াজ যদি না উঠত, 'নবান্ন' লেখা হতনা। সেই নাট্য প্রয়োগে শিশিরবাবু এতটাই আলোড়িত হয়েছিলেন যে, শ্রীরলাম মঞ্চে কৃষকের জীবনালেখ্য লেখার জন্য তাঁকে ডেকে আনতে হয়েছিল তুলসী লাহিড়িকে। অভিনীত হয়েছিল 'দুঃখীর ইমান'।
'নবান্ন' নাটকটির সঙ্গে বাংলায় গণনাট্য সংযোগ উদ্ভব জড়িত। বাংলায় গান ও নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে গণনাট্য সংঘ একটি যুগান্তরের সূচনা করে। বিজনবাবু গণনাট্যের এক প্রধান পরিচালক হিসাবে এই নাটকটি রচনা করেন, এর অভিনয় পরিচালনাকরেন, নিজে অভিনয় করেন। 'নবান্ন' নাটক এবং গণনাট্য যেন একাত্ম হয়ে আছে। 'নীলদর্পণ' নাটক আশ্রয় করে বাংলায় ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্ভব হয়েছিল। তেমনি 'নবান্ন'কে আশ্রয় করে গণনাট্যের জন্ম। পার্থক্য এইটুকু নীলদর্পণের লেখক ন্যাশানাল থিয়েটারের কথা ভেবে ৬ বছর আগে নাটকটি লেখেন নি। অন্য পথে নবান্নের লেখক গণনাট্যের জন্যই এই নাটক লেখেন এবং এর অভিনয় করবার দায়িত্বও গ্রহণ করেন।
বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটক প্রসঙ্গে তাই গণনাট্যের সূচনাকালীন ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় সংক্ষেপে সূত্রাকারে বলা যেতে পারে:
১। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বনসি-বিরোধী লেখক ও শিল্পীদের যে সংঘ তৈরি হয়েছিল তার নাট্যসংগীত শাখা রূপে গণনাট্য সংঘের জন্ম।
২। সমকালীতন রঙ্গঙ্গমঞ্চের বাণিজ্যিক পেশাদারী চরিত্রের বিরুদ্ধে এঁরা সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বন্ধ নাটক লেখা ও প্রযোজনা প্রস্তুতি নেন। পেশাদারি মঞ্চের মঞ্চসজ্জা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক যে বিপুল ব্যায়ের দিক থাকে তার স্থানে এর সুলভ প্রযোজনা।
৩। বাঁধা মঞ্চে সমাজসচেতন নাটকের অভাব ছিল একথা বলা হবে অনৈতিহাসিক। নানা ধরনের নাটকের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বদেশপ্রাণতা সেখানেও দেখা গেছে। বহুবিবাহ, কৌলীন্য, নারীর সামাজিক পারিবারিক লাঞ্ছনার তীব্র সমালোচনাও দেখি। প্রহসনে আরও নানা জীবন্ত সমাজ সমস্যা প্রতিফলিত হয়েছে।
৪। গণনাট্যের নাটক এবং প্রযোজনা থিয়েটারের ক্ষেত্রে একক। স্টার অভিনেতার স্থানে একটা সমগ্রতা-পুরো নাট্যগোষ্ঠীর সামগ্রিক সাফল্যের দিকে নতুন দরজা খুলে দেয়।
তুলসী লাহিড়ির লেখা 'মায়ের দাবি', 'দুঃখীর ইমান', 'ছেড়া তার', 'পথিক' ইত্যাদি নাটক গণনাট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য নাট্যরচনার মধ্যে আছে 'মণিকাঞ্চন', 'বাংলার মাটি', 'সাবিত্রী', 'বেজায় ব?? প্রভৃতি। তাঁর কোনো কোনো নাটকে প্রচলিত প্রথানুগ নাট্যরচনার ধারা অনুসৃত হলেও যে তিনটি নাটকের জন্য তাঁর খ্যাতি, এবং যে একাঙ্ক নাটকগুলিতে তাঁর সাফল্য সেগুলি সবই সমকালীন গণনাট্যের দ্বারা প্রভাবিত। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ঠিকাদারি, জোতদারি, কৃষকদের প্রতিরোধ, খনি অঞ্চলের শ্রমিক আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়বস্তু তাঁর নাটকে বাস্তব হয়ে উঠেছে। তাঁর নাটকের একটি প্রধান গুণ সংলাপে আঞ্চলিক উপভাষার ব্যবহারে নাট্যবস্তুকে প্রাণচঞ্চল করে তোলা। তাঁর নাটক শুধু কৃষক সংগ্রামের চিত্র না হয়ে মানববেদনার অভ্যন্তরে কাহিনি হয়ে উঠেছে।
বুদ্ধদেব বসু কবি ও কথা সাহিত্যিক হিসাবে প্রসিদ্ধ হলেও কয়েকটি বিশিষ্ট নাটকের রচয়িতা হিসাবেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান করে নিয়ছেন। তাঁর 'বাবু ও বিবি' কতকটা অ্যাবসার্ড নাটকের মডেলে লেখা। তাঁর উল্লেখযোগ্য পুরানাশ্রয়ী কাব্য-নাট্য 'তপস্বী ও তরঙ্গিনী', 'প্রথম পার্থ', 'অনাম্নী অঙ্গনা' যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে।
পরিশেষে বলা যেতে পারে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ হল বামপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বে পরিচালিত থিয়েটার শিল্পীদের সংগঠন। এটির লক্ষ্য ছিল ভারতের জনসাধারণের মধ্যে বামপন্থী মতাদর্শ প্রচার এবং তাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটান যাতে এই সংস্থা সফলতা লাভ করেছিল।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।