ভিয়েনা সম্মেলন (১৮১৫) সম্পর্কে টীকা লেখো। ইউরোপে এই সম্মেলনের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

Nil's Niva
0

প্রশ্ন: ভিয়েনা সম্মেলন (১৮১৫) সম্পর্কে টীকা লেখো। ইউরোপে এই সম্মেলনের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?   

*****************************************

উত্তর: নেপোলিয়নের পতনের পর বিজয়ী শক্তিবর্গের প্রতিনিধিরা অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে সমবেত হন। এই ভিয়েনা-সম্মেলনে (সেপ্টেম্বর, ১৮১৪-জুন, ১৮১৫ খ্রীঃ) অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ জটিল ও ব্যাপক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল এবং তাদের সমাধানসূত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল) এই বিচারে ভিয়েনা-সম্মেলন-এর মত রাজনৈতিক সমাবেশ ইতিপূর্বে কখনও সংঘটিত হয় নি। 

          ভিয়েনা-সম্মেলনে বহু ধুরন্ধর রাজনীতিবিদের সমাবেশ ঘটেছিল। এঁদের মধ্যে অস্ট্রিয়ার রাজা প্রথম ফ্রান্সিস ও প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিক, রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজাণ্ডার, প্রাশিয়ার তৃতীয় ফেডারিক, ইংলণ্ডের ক্যাসালরি, ফ্রান্সের তালেরী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। তুরস্ক ব্যতীত সমস্ত রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এখানে সমবেত হন। তাই ভিয়েনা-কংগ্রেসকে 'প্রথম আন্তজাতিক সম্মেলন' বলে অভিহিত করা হয়। অবশ্য রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ইংল্যাণ্ড- নেপোলিয়ন-বিরোধী শক্তিজোটের এই চার প্রধান রাষ্ট্রই ভিয়েনা-সম্মেলনের ভাগ্যনিয়স্তা হয়ে ওঠেন। অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিক সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, বাগ্মিতা ও কূটকৌশলের দ্বারা তিনি খুব কম সময়ের মধ্যেই সম্মেলনে অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হন। পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধি তালেরাঁ-ও এই সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। তিনি এই তত্ত্ব প্রচার করেন যে, ইউরোপের যুদ্ধ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে নয়। তাই ফ্রান্স এখানে পরাজিত শক্তি নয়, মিত্রশক্তি হিসেবেই মর্যাদার অধিকারী। তালেরী নিজ-বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হজ ও অবহেলিত রাষ্ট্রবর্গের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ভিয়েনাতে সমবেত রাষ্ট্রবর্গের মধ্যে ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়াকে 'বড় চারজন' বলে ঐতিহাসিকেরা চিহ্নিত করেছেন। এই রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ স্বার্থপূরণের নির্বিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এখানে সমবেত হয়েছিল। অস্ট্রিয়ার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ফরাসী বিপ্লবজনিত জাতীয়তাবাদ ও উদারতাবাদের নির্মূল ঘটানো। কারণ বহু ভাষা ও জাতি অধ্যুষিত অস্ট্রিয়ার সংহতির পক্ষে জাতীয়তার চেতনা বিপজ্জনক বলে প্রতিভাত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের লক্ষ্য ছিল তার উপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ সম্প্রসারণের স্বার্থে ইউরোপের অস্থিরতার অবসান ঘটানো এবং ভবিষ্যতে ফরাসী বিপ্লবের মত অস্থির জাগরণের সম্ভাবনা বিনষ্ট করা। রাশিয়া ও প্রাশিয়াও ইউরোপে নিজ নিজ ক্ষমতার এলাকা সম্প্রসারিত করতে সচেষ্ট ছিল। ফরাসী প্রতিনিধির প্রধান লক্ষ্য ছিল মিলিত 'বড় চারজনের' ক্ষোভ থেকে রাজতান্ত্রিক ফ্রান্সের স্বার্থ রক্ষা করা।

           ভিয়েনা-সম্মেলনের সামনে উত্থাপিত সমস্যা সংখ্যায় ছিল যেমন অসংখ্য তেমনি তাদের চরিত্র ছিল বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ। সদস্যরা সমস্যাগুলিকে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী প্রথমে ভাগ করে নেন এবং তাদের সমাধানে নিয়োজিত হন। যেমন- (১) নেপোলিয়ন কর্তৃক বিজিত রাষ্ট্রগুলিকে নতুন করে সংগঠিত করা, (২) নেপোলিয়ন কর্তৃক বিতাড়িত পুরাতন রাজবংশগুলিকে পুনর্বাসিত করা, (৩) ফ্রান্স সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা, (৪) পোল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা, (৫) নেপোলিয়ন- বিরোধী চুক্তিগুলিকে মর্যাদা দেওয়া এবং (৬) ফরাসী-বিপ্লবের ভাবধারায় যাতে পুনরায় ইউরোপে বিপ্লবের আগুন না-ছড়ায়, তার ব্যবস্থা করা।

                উপরিলিখিত সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ কয়েকটি নীতি গ্রহণ করেন। এগুলি হল- 'ন্যায্য অধিকার', 'ক্ষতি পূরণ' এবং 'শক্তিসাম্য'। এছাড়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নীতিও গৃহীত হয়।

            ন্যায্য অধিকার-নীতি অনুসারে বিপ্লব ও নেপোলিয়নীয় যুগে বিতাড়িত বৈধ রাজবংশগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন বুরবোঁবংশের অষ্টাদশ ন্যায্য-অধিকার লুই। স্পেন, সিসিলি ও নেপল্ল-এ বুরবোঁবংশীয় রাজারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। হল্যান্ড-এর সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয় অরেঞ্জবংশকে; সার্ডিনিয়া, পিয়েডমন্টে স্যাভয় রাজবংশ পুনঃস্থাপিত হয়। পোপ তাঁর রাজ্য ফিরে পান এবং জার্মানীতে পুনরায় অস্ট্রিয়ার আধিপত্য স্থাপন করা হয়।

             ক্ষতিপূরণ-নীতি অনুসারে অস্ট্রিয়া লাভ করে উত্তর-ইতালীর লোম্বার্ডি ও ভেনেসিয়া প্রদেশ এবং টাইরল, সালজবার্গ ও ইলিরিয়া অঞ্চল। প্রাশিয়া ক্ষতিপূরণ হিসেবে পায় পোজেন, থর্ন, ডানজিগ ও স্যাক্সনির উত্তরাংশ। পশ্চিম পোমেরেনিয়া এবং রাইন নদীর তীরবর্তী ক্ষতিপূরণ প্রদেশগুলিও প্রাশিয়া লাভ করে। রাশিয়া লাভ করে পোজেন ও থর্ন বাদে

             গ্র্যান্ড ডাচি অব্ ওয়ারশ-এর অধিকাংশ অঞ্চল এবং ফিনল্যান্ড ও বেসারাবিয়ার অন্যান্য অঞ্চল। এর ফলে পশ্চিম-ইউরোপে রুশ-প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা যায়। ইংল্যাণ্ড ক্ষতিপূরণ হিসেবে লাভ করে সিংহল, কেপ কলোনী, পশ্চিম-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, মাল্টা, হ্যালিগোলান্ড, আইওনীয়ন দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি স্থান। ফলে ইংল্যান্ডের নৌ-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করে। সুইডেন প্রাশিয়াকে পোমেরেনিয়া দানের পরিবর্তে নরওয়ে লাভ করে। জার্মানীর রাষ্ট্রগুলিকে একত্রিত করে একটি অসংবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হয় এবং আইনত অস্ট্রিয়ার অধীনে স্থাপন করা হয়।



জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার

তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি

অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
bookstore