প্রশ্নঃ কৃত্তিবাসী রামায়ণের 'অযোধ্যাকাণ্ড' অবলম্বনে দশরথের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

Nil's Niva
0

প্রশ্নঃ কৃত্তিবাসী রামায়ণের 'অযোধ্যাকাণ্ড' অবলম্বনে দশরথের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

কৃত্তিবাসী রামায়ণের 'অযোধ্যাকাণ্ড' মহারাজ দশরথের জীবনের চরম ট্র্যাজেডি এবং মানসিক দ্বন্দ্বের এক মর্মস্পর্শী দলিল। এই কাণ্ডে দশরথ কেবল একজন সম্রাট নন, বরং একজন রক্ত-মাংসের মানুষ ও আবেগপ্রবণ পিতা হিসেবে আমাদের সামনে ধরা দিয়েছেন। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন দিক নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

দশরথের চরিত্রের সবচেয়ে বড় দিক হলো তাঁর অগাধ পুত্রস্নেহ। রামচন্দ্র ছিলেন তাঁর নয়নের মণি। বৃদ্ধ বয়সে রামকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর জীবনের পরম তৃপ্তির লক্ষ্য। কিন্তু যখন কৈকেয়ী তাঁর কাছে রামের চৌদ্দ বছরের বনবাস ও ভরতের রাজ্যাভিষেক বর হিসেবে চাইলেন, তখন দশরথের আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি বারবার কৈকেয়ীর পায়ে ধরে অনুনয় করেছেন, এমনকি রাজ্য দিয়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু রামকে চোখের আড়াল করতে চাননি। তাঁর এই বিলাপ ও কান্না আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, রাজমুকুটের চেয়েও তাঁর কাছে রামের সান্নিধ্য অনেক বেশি মূল্যবান ছিল।

দশরথ ছিলেন ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা, যে বংশে 'সত্য' রক্ষা করা প্রাণের চেয়েও প্রিয়। অতীতে দেবাসুর যুদ্ধে কৈকেয়ী তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন বলে তিনি দুটি বর দিতে অঙ্গীকার করেছিলেন। সেই অঙ্গীকারে তিনি আবদ্ধ ছিলেন। একদিকে রামের প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে সত্য রক্ষার বাধ্যবাধকতা—এই দুইয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে তিনি এক চরম নৈতিক সংকটে পড়েন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে দেখা যায়, তিনি অধর্ম করতে চাননি বলেই অত্যন্ত হৃদয়বিদারকভাবে রামকে বনবাসে পাঠানোর আদেশ মেনে নিতে বাধ্য হন। তাঁর এই সত্যনিষ্ঠা তাঁকে করুণ রসাত্মক এক মহানায়কে পরিণত করেছে।

দশরথের এই যন্ত্রণার মূলে ছিল তাঁর যৌবনের এক অনিচ্ছাকৃত অপরাধ। শব্দভেদী বাণ ছুঁড়ে তিনি অন্ধকারে অন্ধমুনির পুত্র সিন্ধুকে হত্যা করেছিলেন। সেই অভিশপ্ত স্মৃতি অযোধ্যাকাণ্ডে পুনরায় ফিরে আসে। তিনি অনুভব করেন যে, পুত্রশোকে তাঁর এই মৃত্যু মূলত সেই অভিশাপেরই ফলশ্রুতি। কৃত্তিবাসের বর্ণনায় দশরথ একজন অসহায় রাজা, যিনি নিজের কৃতকর্মের কাছে এবং নিয়তির কাছে সম্পূর্ণ নতিস্বীকার করেছেন।

রাম যখন পিতৃসত্য পালনের জন্য বনবাসে যাত্রা করেন, দশরথের জীবনশক্তি যেন তখনই নিঃশেষ হয়ে যায়। রামহীন অযোধ্যা তাঁর কাছে শ্মশানের মতো মনে হয়েছিল। রামের বিচ্ছেদে তিনি আহার-নিদ্রা ত্যাগ করেন। ‘হা রাম’ ‘হা রাম’ বলে বিলাপ করতে করতে অবশেষে তিনি দেহত্যাগ করেন। তাঁর এই মৃত্যু সাধারণ কোনো রাজার মৃত্যু নয়, বরং এটি হলো পিতৃস্নেহের এক চরম বলিদান।

পরিশেষে বলা যায়, কৃত্তিবাসী রামায়ণে দশরথ কোনো অবিচল বীর নন, বরং অত্যন্ত মানবিক এক চরিত্র। তিনি স্নেহের কাছে দুর্বল, সত্যের কাছে দায়বদ্ধ এবং ভাগ্যের কাছে পরাজিত। তাঁর এই স্নেহশীলতা এবং পরিস্থিতির কাছে তাঁর অসহায় আত্মসমর্পণ পাঠকদের মনে গভীর সহানুভূতির সৃষ্টি করে। তিনি একাধারে একজন ন্যায়নিষ্ঠ রাজা এবং এক হতভাগ্য পিতা, যার জীবনাবসান ঘটেছিল কেবলই পুত্রবিরহের তীব্র যন্ত্রণায়।

জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার

তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি

অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।

Tags

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
bookstore