প্রশ্নঃ সাম্প্রদায়িকতা বলতে কী বোঝ? সাম্প্রদায়িকতার
কারণ আলোচনা করো। সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণের উপায়গুলি সম্পর্কে আলোচনা কর।
v সাম্প্রদায়িকতাঃ
সাম্প্রদায়িকতা হল এমন একটি ভাবাদর্শ যার দ্বারা সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত
করা হয়। বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত ও বিশ্বাসী মানুষ পরস্পর পরস্পরের ধর্মকে শত্রুতার চোখে
দেখে থাকে। সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন মানুষ পরস্পর পরস্পরের ধর্মের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ
হয়ে থাকে। সাম্প্রদায়িকতা হল কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তার নিজের ধর্মের প্রতি
গভীর ভালোবাসা ও অন্ধবিশ্বাস। তবে শুধু এতটুকু ব্যাখ্যার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা
সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা যায় না। কোনো ধর্মমতের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে স্বধর্মের
প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস বা আসক্তিকে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতা বললে ভুল
হবে। সাম্প্রদায়িকতার পরিস্থিতি তখনই সৃষ্টি হবে যখনই বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ
নিজের ধর্মের প্রতি আসক্ত হয়ে অন্য ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন করে। নিজের
ধর্মকে ভালোবাসতে গিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ বা প্ররোচনামূলক কাজ
করে থাকলে তাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে। অর্থাৎ এককথায় বলা যেতে পারে একটি ধর্মসম্প্রদায়ের
মানুষ অন্য একটি ধর্মসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ এবং ঘৃণার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে।
এই সাম্প্রদায়িকতা হল বর্তমান বিশ্বের ভয়াবহ সমস্যা। ভারতবর্ষও এর যাঁতাকলে দিশেহারা,
ভারতবর্ষে একাধিক সমস্যার মধ্যে বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতা অত্যন্ত দুরারোগ্য ব্যাধির
মতো সমাজকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রয়েছে। সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার ফলে বিভিন্ন ধর্মীয়
সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এবং সম্প্রীতির পরিবর্তে গড়ে ওঠে বৈরিতামূলক সমাজ।
v ভারতে সাম্প্রদায়িকতার
কারণঃ
১. সাম্প্রদায়িক রাজনীতিঃ সাম্প্রদায়িক
রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতা উন্মেষের মূল কারণ বলা যেতে পারে। ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক
নেতৃবৃন্দ রাজনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক রাখার পরিবর্তে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করছে। নেতাদের
সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা বা গুরুদেবের
দ্বারস্থ হতে দেখা যায়। রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের
ভোটব্যাংক বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে উস্কে দিয়ে থাকেন।
বিভিন্ন ভোটের সময় যে অঞ্চলে যে ধরনের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে সেখানে সেই ধরনের
ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তৃতার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের নেতারা মত্ত হয়ে
ওঠেন।
২. সাম্প্রদায়িক গণমাধ্যমঃ বর্তমান দিনে
বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গণমাধ্যম সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করছে। সাম্প্রদায়িক সংবাদপত্র, সাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তক এবং বর্তমান দিনের বৈদ্যুতিক
সামাজিক গণমাধ্যম দ্রুত সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক
নেতাদের নিজেদের সংবাদপত্র ও প্রচার পুস্তিকা রয়েছে।
৩. বৈদেশিক ষড়যন্ত্রঃ বৈদেশিক ষড়যন্ত্র
চক্রান্ত অনেক সময় সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে থাকে। বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে
পর্যুদস্ত করতে বিভিন্ন দেশ সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের জাল বপন করে। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক
সংগঠনগুলোকে গোপনে অর্থ ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে দুর্বল
করে দেওয়া এদের মূল লক্ষ্য।
৪. ধর্মান্তরকরণঃ বিভিন্ন সময়
বিভিন্ন ধর্মের ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে
সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো সংখ্যাগুরু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বশ্যতা স্বীকার করতে
বাধ্য হয়। স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরকরণ বা জোর করে ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া কোনো ধর্মের প্রতি
অন্ধ আনুগত্যকে প্রকাশ করে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো বিভিন্ন সময়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের
সমাজ-সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে স্বতন্ত্র ধর্মসংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
৫. ধর্মগুরুদের ভূমিকাঃ বর্তমানে
সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবের পেছনে ধর্মগুরুদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন
ধর্মের ধর্মগুরু তাঁদের ধর্মীয় চেতনাকে উৎসাহিত করার জন্য সাম্প্রদায়িকমূলক কথাবার্তা
বলে থাকেন। ফলে ধর্মের শীর্ষস্থানীয় গুরুদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ধর্মীয় মৌলবাদী ভাবধারা দ্বারা তাঁরা প্রভাবিত হচ্ছেন। বিভিন্ন ধর্মগুরু রাজনৈতিক নেতাদের
দ্বারা পরিচালিত হয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তির মতো কথাবার্তা বলছেন এবং অনেক সময় সরকারের বিরুদ্ধে
জিহাদ ঘোষণা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছেন।
v সাম্প্রদায়িকতা
দূরীকরণের উপায়ঃ
১. নাগরিক সমাজের ভূমিকাঃ সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গাহাঙ্গামা এবং সাম্প্রদায়িক কথোপকথন থেকে নাগরিক সমাজকে মুক্ত রাখা উচিত। সাধারণ
জনসমাজ বা নাগরিক সমাজ নিজেদেরকে যদি সাম্প্রদায়িকীকরণ থেকে মুক্ত রাখতে পারে তাহলে
সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারলাভে বাধাপ্রাপ্ত হবে।
২. সুপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থাঃ সুপরিকল্পিত
শিক্ষাব্যবস্থা সাম্প্রদায়িকতা প্রতিকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বলে বিবেচিত
হয়। সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা সাম্প্রদায়িকতা প্রসারের জন্য দায়ী। সাম্প্রদায়িক
নামযুক্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন-আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি এবং বেনারস হিন্দু
ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাম্প্রদায়িকতার ধারক-বাহক। সাম্প্রদায়িকতা
রোধে এই সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনতিকালের মধ্যেই বন্ধ করা উচিত। স্কুল-কলেজে যদি নিরপেক্ষ
শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রসার এবং জাতীয় ঐক্যরক্ষার শিক্ষা
প্রদান করা যায় তাহলে গোড়াতেই সাম্প্রদায়িকতার বীজকে নির্মূল করা সম্ভব।
৩. গণমাধ্যমের ভূমিকাঃ সাম্প্রদায়িকতা
প্রতিরোধে গণমাধ্যমগুলির সদর্থক ভূমিকা পালন করা দরকার। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট
হয় এধরনের কোনো সংবাদ পরিবেশন করা অনুচিত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য ধর্মীয়
প্রচার পরিবেশন বন্ধ করে সুস্থসবল জনমত গঠনের দিকে গণমাধ্যমগুলির জোর দেওয়া উচিত।
৪. জোরজরবদন্তি ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে আইনঃ জোরজবরদস্তি
ধর্মান্তরকরণ সাম্প্রদায়িকতার চরমতম ফলাফল। সংখ্যাগুরু ধর্মীয় জনগোষ্ঠী যাতে কোনোভাবেই
সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরকরণ করতে না পারে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইন
বলবৎ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
৫. জাতপাতের অবসানঃ জাতপাতের
ভেদাভেদ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রাথমিক পর্ব। সাম্প্রদায়িকতার বিভেদকে সমূলে উৎপাটন
করতে হলে মানুষের মধ্যে জাতপাতের ভেদাভেদকে সর্বাগ্রে দূরীকরণ করা প্রয়োজন। জাতপাতের
ভেদাভেদের মধ্যে নিহিত থাকে ধর্মীয় ভেদাভেদ। সুতরাং জাতপাতভিত্তিক বৈষম্যের অবসান
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।