হিন্দুদের প্রতি আকবরের নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো।

Nil's Niva
0

প্রশ্নঃ হিন্দুদের প্রতি আকবরের নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো।

আকবর ছিলেন অত্যন্ত উদার মনের অধিকারী। তিনি সকল ধর্মের সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন। হিন্দুদের সাথে তাঁর আচরণ ছিল অত্যন্ত সহনশীল। প্রকৃতপক্ষে, তিনি তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এতটাই উদার ছিলেন যে তিনি সকল ধর্মের ভালো দিকগুলির ভিত্তিতে একটি নতুন ধর্ম আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছিলেন। অবশ্যই তিনি তার প্রজাদের উপর তার ধর্ম জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার কোন চেষ্টা করেননি।

আকবরের হিন্দু-নীতির বিভিন্ন দিকঃ আকবরের হিন্দু-নীতি ছিল বহুমুখী এবং সুদূরপ্রসারী। একে কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে:

১. বৈষম্যমূলক কর বিলোপ ও আর্থিক সমতা স্থাপনঃ আকবরের হিন্দু-নীতির সবচেয়ে যুগান্তকারী এবং প্রশংসনীয় পদক্ষেপ ছিল হিন্দুদের উপর থেকে বৈষম্যমূলক করের বিলোপ।

তীর্থকর রদঃ হিন্দুধর্মাবলম্বীরা যখন গয়া, মথুরা প্রভৃতি পবিত্র স্থানে তীর্থ করতে যেতেন, তখন তাঁদের উপর এক ধরনের কর আরোপ করা হতো। আকবর ১৫৬৩ সালে এই ‘তীর্থকর’ সম্পূর্ণরূপে রদ করে দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, মানুষ নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী ঈশ্বরের উপাসনা করবে এবং এর জন্য রাষ্ট্রকে কোনো কর দিতে হবে না। এই পদক্ষেপটি ছিল হিন্দুদের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি সম্রাটের গভীর শ্রদ্ধার প্রতীক।

জিজিয়া কর বিলোপঃ এর এক বছর পর, ১৫৬৪ সালে, আকবর অমুসলিমদের উপর আরোপিত ‘জিজিয়া কর’ বিলুপ্ত করেন। ইসলামিক আইনানুযায়ী, মুসলিম শাসিত রাজ্যে বসবাসকারী অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিনিময়ে এই কর দিতে হতো। এই করটি ছিল অমুসলিমদের জন্য একাধারে আর্থিক বোঝা এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার প্রতীক। জিজিয়া করের বিলুপ্তি ঘটিয়ে আকবর কার্যত রাষ্ট্রের চোখে সকল প্রজাকে সমানাধিকার প্রদান করেন। এটি ছিল এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ, যা হিন্দু প্রজাদের মনে সম্রাটের প্রতি গভীর আস্থা ও আনুগত্য তৈরি করে।

২. প্রশাসনে হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগঃ আকবর ‘গুণতন্ত্রে’ বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় পরিচয়ের পরিবর্তে যোগ্যতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। তাঁর শাসনকালে বহু হিন্দু ব্যক্তি সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ সামরিক ও বেসামরিক পদে আসীন হয়েছিলেন।

রাজা টোডরমল: তিনি ছিলেন আকবরের অর্থমন্ত্রী। তাঁর প্রবর্তিত ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা, যা ‘জাবতি প্রথা’ বা ‘দহসালা বন্দোবস্ত’ নামে পরিচিত, মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামোকে মজবুত করেছিল। তাঁর সংস্কার কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের আয়কেও সুনিশ্চিত করে।

রাজা মানসিংহঃ অম্বরের এই রাজপুত রাজা ছিলেন আকবরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতিদের মধ্যে একজন। তিনি কাবুল থেকে বাংলা পর্যন্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযানে মুঘল বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন এবং বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

৩. রাজপুত নীতি ও বৈবাহিক সম্পর্কঃ আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে, উত্তর ভারতের শক্তিশালী রাজপুতদের সঙ্গে সংঘাতের পরিবর্তে মৈত্রী স্থাপন করলে তা সাম্রাজ্যের জন্য মঙ্গলজনক হবে। এই লক্ষ্যে তিনি এক অভিনব ‘রাজপুত নীতি’ গ্রহণ করেন।

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন: তিনি রাজপুত রাজপরিবারগুলোর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। ১৫৬২ সালে তিনি অম্বরের রাজার কন্যাকে বিবাহ করেন। এই ধারা অব্যাহত রেখে তিনি বিকানীর ও জয়সলমীরের রাজকন্যাদেরও বিবাহ করেন।

ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান: গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আকবর তাঁর হিন্দু স্ত্রীদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেননি। বরং রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে তাঁদের নিজ ধর্ম পালন, পূজা-অর্চনা এবং নিজস্ব প্রথা-রীতি মেনে চলার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এটি ছিল তৎকালীন সময়ের নিরিখে এক অভাবনীয় পদক্ষেপ।

সম্মান ও অংশীদারিত্ব: বিবাহের মাধ্যমে তিনি রাজপুতদের কেবল আত্মীয় হিসেবেই গ্রহণ করেননি, তাঁদের সাম্রাজ্যের অংশীদার করে তুলেছিলেন। রাজপুত রাজারা তাঁদের নিজ রাজ্য শাসনের অধিকার অক্ষুণ্ণ রেখে মুঘল সাম্রাজ্যের বিশ্বস্ত স্তম্ভে পরিণত হন।

৪. ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ঃ আকবরের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন ছিল অত্যন্ত উদার। তিনি সকল ধর্মের সত্যকে জানার জন্য আগ্রহী ছিলেন।

ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠাঃ এই উদ্দেশ্যে তিনি ফতেপুর সিক্রিতে ‘ইবাদতখানা’ বা উপাসনা গৃহ নির্মাণ করেন। প্রথমে কেবল সুন্নি মুসলিম পণ্ডিতদের নিয়ে বিতর্ক শুরু হলেও তাঁদের গোঁড়ামি ও অসহিষ্ণুতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আকবর শিয়া, সুফি এবং পরবর্তীকালে হিন্দু পণ্ডিত, জৈন মুনি, পার্সি পুরোহিতদেরও আমন্ত্রণ জানান। এই সকল ধর্মের সারবত্তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

সুলহ-ই-কুল নীতিঃ এই আলোচনা থেকে তিনি ‘সুলহ-ই-কুল’ বা ‘সকলের প্রতি শান্তি’ নীতির আদর্শে উপনীত হন। এই নীতির মূল কথা ছিল, কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ না রেখে সকলের সঙ্গে সম্প্রীতি ও শান্তির সঙ্গে বসবাস করা। এটিই তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।

দীন-ই-ইলাহিঃ তাঁর ধর্মীয় চিন্তার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ‘দীন-ই-ইলাহি’ নামক একটি নতুন মতবাদ। এটি কোনো সংগঠিত ধর্ম ছিল না, বরং বিভিন্ন ধর্মের ভালো দিকগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি একেশ্বরবাদী আধ্যাত্মিক পথ বা আদর্শ। এর উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যের অভিজাতদের সংকীর্ণ ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তুলে এক আনুগত্যের সূত্রে বাঁধা। তিনি কাউকে এই মত গ্রহণে বাধ্য করেননি।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, হিন্দুদের প্রতি আকবরের নীতি ছিল তাঁর শাসনকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এটি কেবল রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফসল ছিল না, বরং এর পেছনে ছিল এক মহান শাসকের মানবিকতা, ঔদার্য এবং সমন্বয়বাদী দর্শন। তাঁর এই নীতির ফলেই মুঘল সাম্রাজ্য শুধুমাত্র একটি সামরিক শক্তি হিসেবে নয়, বরং একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তিনি হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে যে সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন, তা পরবর্তীকালে এক মিশ্র ও বহুত্ববাদী ‘হিন্দুস্তানি’ পরিচিতি নির্মাণে সহায়তা করে। যদিও তাঁর পরবর্তী কিছু শাসক এই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন, তবুও আকবরের ‘সুলহ-ই-কুল’ নীতি আজও এক বহু-সাংস্কৃতিক ও বহু-ধর্মীয় সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক শাশ্বত বার্তা বহন করে।


জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার

তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি

অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
bookstore