প্রশ্ন- ডাকঘর
নাটকের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ডাকঘর' নাটকটির নামকরণ
তাৎপর্যপূর্ণ এবং নাটকের মূল বিষয়বস্তু ও অন্তর্নিহিত ভাবনার সঙ্গে গভীরভাবে
সম্পৃক্ত। আপাতদৃষ্টিতে একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠানের নাম হলেও, 'ডাকঘর' নাটকের
প্রেক্ষাপটে এটি এক গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনা ধারণ করে, যা নাটকের মর্মার্থ অনুধাবনে
সহায়ক।
নাটকের
কেন্দ্রীয় চরিত্র অমল, এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত পাঁচ বছর বয়সী বালক, যে
ঠাকুরদাদার বাড়িতে বন্দি জীবন কাটায়। বাইরের মুক্ত পৃথিবীর আলো-বাতাস, সবুজ মাঠ
তার কাছে কেবলই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা এক স্বপ্নিল জগৎ। এই বন্দি জীবনে অমলের
প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে রাজার আগমন এবং তার কাছ থেকে একটি চিঠির প্রত্যাশা।
গ্রামের ডাকঘরের লোকটি যখন অমলকে রাজার চিঠি আসার সম্ভাবনার কথা জানায়, তখন থেকেই
ডাকঘর অমলের কাছে এক বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে। এটি কেবল চিঠি আদান-প্রদানের একটি
স্থান না থেকে, তার আকাঙ্ক্ষা, আশা এবং বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের
প্রতীকরূপে উপস্থাপিত হয়।
'ডাকঘর'
নামটি অমলের প্রতীক্ষার কেন্দ্রবিন্দুকে নির্দেশ করে। অমল সারাক্ষণ জানালার পাশে
বসে থাকে, পথিকের আনাগোনা দেখে এবং রাজার চিঠির অপেক্ষায় দিন গোনে। তার কাছে
ডাকঘর সেই স্থান, যেখান থেকে রাজার অপ্রত্যাশিত বার্তা তার বন্দি জীবনে মুক্তির
আনন্দ নিয়ে আসতে পারে। এই প্রতীক্ষা নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। অমলের
কৌতূহলী মন বাইরের জগতের রহস্য জানতে চায় এবং রাজার চিঠি যেন সেই রহস্যের দ্বার
উন্মোচনকারী এক চাবিকাঠি।
'ডাকঘর'
নামটি বৃহত্তর অর্থে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। অমলের রাজার চিঠির প্রতীক্ষা আসলে
প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে লুকানো এক অসীম প্রত্যাশার রূপক। মানুষ সর্বদা কোনো
না কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করে - সুখ, শান্তি, মুক্তি অথবা কোনো অপ্রত্যাশিত শুভ
কিছুর আগমন। অমলের এই প্রতীক্ষা সেই সার্বজনীন মানব অনুভূতির প্রতিচ্ছবি, যেখানে
ডাকঘর সেই আকাঙ্ক্ষার বাহন হিসেবে কাজ করে।
'ডাকঘর'
নাটকে যোগাযোগ ও সংযোগের একটি প্রতীক হিসেবেও কাজ করে। অমল বন্দি জীবনে বাইরের
জগতের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পারে না। ডাকঘর সেই অনুপস্থিত সংযোগের একটি
ক্ষীণ আশা জাগিয়ে রাখে। রাজার চিঠি যেন সেই দূরবর্তী, রহস্যময় জগতের সঙ্গে অমলের
একমাত্র সম্ভাব্য যোগসূত্র। যদিও বাস্তবে সেই চিঠি কখনোই আসে না, তবুও ডাকঘরের
ধারণা অমলের মনে এক ধরনের মানসিক সংযোগ স্থাপন করে, যা তাকে একাকীত্ব ও হতাশা থেকে
কিছুটা হলেও রক্ষা করে।
নাটকের
শেষে রাজার চিকিৎসকের আগমন এবং তার শান্ত বাণী যেন এক ভিন্ন স্তরের সংযোগের ইঙ্গিত
দেয়। রাজার অপ্রত্যাশিত দূত যখন অমলের শিয়রে এসে দাঁড়ান, তখন জাগতিক ডাকঘরের
গুরুত্ব ম্লান হয়ে যায় এবং এক আধ্যাত্মিক যোগাযোগের সূচনা হয়। অমলের প্রস্থান
যেন সেই পরম রাজার ডাকে সাড়া দেওয়া, যেখানে জাগতিক চিঠির আর কোনো প্রয়োজন নেই।
এই প্রেক্ষাপটে 'ডাকঘর' নামটি লৌকিক জগতের সংযোগের আকাঙ্ক্ষা থেকে অলৌকিক জগতের
আহ্বান পর্যন্ত বিস্তৃত একটি ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে।
'ডাকঘর'
নামটি নাটকের আপাত সরল কাঠামোর বিপরীতে এক গভীর দার্শনিক তাৎপর্য বহন করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের নশ্বরতা, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং এক অদেখা রহস্যময় জগতের
প্রতি মানুষের চিরন্তন আকুলতাকে এই ছোট্ট নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। ডাকঘর সেই
বৃহত্তর রহস্যের একটি প্রবেশদ্বারস্বরূপ, যেখানে পার্থিব আকাঙ্ক্ষার সমাপ্তি ঘটে
এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির সূচনা হয়।
পরিশেষে
বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ডাকঘর' নাটকের নামকরণ অত্যন্ত সার্থক এবং
বহুস্তরবিশিষ্ট। এটি কেবল নাটকের প্রধান চরিত্রের প্রতীক্ষার স্থানকে নির্দেশ করে
না, বরং মানব হৃদয়ের অসীম আকাঙ্ক্ষা, জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সংযোগের বাসনা এবং
জীবনের বৃহত্তর রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। 'ডাকঘর' নামটি নাটকের মূল সুর ও
অন্তর্নিহিত ভাবনার সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে, অন্য কোনো নামে এই নাটকের গভীরতা ও
তাৎপর্য সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। এই নামকরণ নাটকের বিষয়বস্তুকে আরও
ব্যঞ্জনাময় ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।