প্রশ্ন ঃ গান্ধার শিল্প সম্পর্কে যা জানো লেখো।
অথবা, শিল্পকলা বলতে কী বোঝো? গান্ধার
শিল্পরীতির উৎপত্তি, বিষয়বস্তু, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো।
বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত পেশোয়ার ও রাওয়ালপিন্ডি
জেলা নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন ভারতের গান্ধার রাজ্য, যার রাজধানী ছিল তক্ষশীলা। এই অঞ্চলে
কুষাণ আমলে ভারতীয় বিষয়বস্তু ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন উপাদানের থেকে এক নতুন শিল্পশৈলীর
উদ্ভব ঘটে; যা 'গান্ধার শিল্প' নামে পরিচিত। পেশোয়ার, কাবুল, কাশ্মীর, জালালাবাদ, হাড্ডা,
বামিয়ান, সোয়াট উপত্যকা প্রভৃতি স্থানে এই শিল্পকলার প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গেছে।
- Ø নির্মাণকাল:
গান্ধার শিল্প বিশেষভাবে কুষাণদের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কারণ, বেশিরভাগ ভাস্কর্যের নির্মাণকাল কুষাণ যুগ। কিন্তু এই শিল্পকলার সূচনা হয় প্রাক্-কুষাণ
যুগে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে এই শৈলীর সূচনা হয় এবং কুষাণ যুগে এর পরিণত রূপ লাভ
করে।
- Ø পটভূমি:
দীর্ঘকাল গান্ধার অঞ্চল যবন অধিকারে ছিল। এই
কারণে এই সময়ের প্রস্তর ভাস্কর্য, পোড়ামাটির মূর্তিগুলির পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার সজ্জায়
যবন তথা গ্রিক প্রভাব পরিস্ফুট। বৌদ্ধধর্ম বিশেষত মহাযান মতবাদের উদ্ভব, গান্ধার শিল্পের
উদ্ভব ও বিকাশের পিছনে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। ইন্দো-গ্রিক, শক-পহুব ও কুষাণগণ এই অঞ্চলে
প্রচলিত বৌদ্ধধর্মের প্রতি যথেষ্ট আনুকূল্য প্রদর্শন করেন। কুষাণ সাম্রাজ্যের সীমান্ত
রাজ্য ব্যাকট্রিয়া, রোমান সাম্রাজ্য থেকে কারিগরগণ কাজের সন্ধানে কুষাণ সাম্রাজ্যে
উপস্থিত হন এবং তাঁরা গৃহ-মন্দিরাদি ও মূর্তি নির্মাণের প্রচুর কাজ পেতেন। গান্ধার
শিল্পের বিকাশে ভৌগোলিক কারণের পাশাপাশি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কারণও বিদ্যমান ছিল। ঐতিহাসিক
ঘটনার মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান। এই অভিযানের ফলেই হেলেনীয়
সংস্কৃতির বীজ বপন হয় ভারতে। এ ছাড়া হখামনীষীয় সম্রাটগণ শাসিত ইরান ও ভারতের মধ্যে
সংযোগ সাধন এবং রোম-ভারত বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি গান্ধার শিল্পের উত্থান ও প্রসারে ব্যাপকভাবে
সাহায্য করেছিল।
- Ø বিষয়বস্তু :
[I] বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব:
গৌতমবুদ্ধের জন্ম-দৃশ্য, সংসার ত্যাগ, ধর্মচক্রপ্রবর্তন,
ধ্যানমগ্নতা, পরিনির্বাণ প্রভৃতি ঘটনা গান্ধার শিল্পে স্থান পেয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত
প্রদেশে, সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া থেকে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের
মূর্তি ও প্রস্তরগাত্রে রূপায়িত জাতক কাহিনির নিদর্শন পাওয়া গেছে।
[II] ধর্মনিরপেক্ষ:
ধনী ও সচ্ছল মানুষের গৃহসজ্জার উপকরণরূপে নির্মিত হয়েছিল
সুরামও নারী, পিঞ্জরা যুবতী, সদ্যোস্নাতা রমণীর কেশগুচ্ছ থেকে জলপানরত সারস মূর্তি।
এইসব মূর্তি সমকালীন নাগরিক সমাজের যৌবন চেতনার প্রতীক ও নিপুণ শিল্পীর পরিচয় বহন করে।
[III] অশ্বারোহী মূর্তি:
আফগানিস্তানের বেগ্রাম অঞ্চলে আবিষ্কৃত অশ্বচালকের টেরাকোটা
সুতি এবং বৌদ্ধ ভাস্কর্যে প্রাপ্ত অশ্বারূঢ় প্রতিকৃতি থেকে জানা যায় যে, অশ্বারোহণ
তাঁদের প্রিয় বিষয় ছিল। একটি আয়তাকার শিলাফলকে দেখা যায় রাজপুত্র সিদ্ধার্থের মহাভিনিষ্ক্রমণ-এর
দৃশ্য উৎকীর্ণ করা রয়েছে। ফলকটি বর্তমানে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম
(লন্ডন)-এ সংরক্ষিত আছে।
[IV] বৈশিষ্ট্য:
ভারতীয় ঐতিহ্য ও শিল্পরীতি ছিল গান্ধার শিল্পের অন্যতম
প্রধান ভিত্তি। এই শিল্প ছিল বৌদ্ধধর্মের প্রতি নিবেদিত। গান্ধার শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য
ছিল গ্রিক-রোমান পদ্ধতিতে গৌতম বুদ্ধের মূর্তির উপস্থিতি। পদ্মাসনের ভঙ্গিতে সিংহাসনে
উপবিষ্ট, ধ্যানরত, অর্ধনিমীলিত নয়ন, সু-অবয়বসম্পন্ন স্বাস্থ্যবান যুবকের দেহ, স-গুম্ফ
তপস্যায় অস্থিপঞ্জরসার ক্ষীণদেহ-গান্ধার শিল্পে নির্মিত এই ধরনের বুদ্ধমূর্তি ভারতের
শিল্পে পূর্বে বা পরে আর কোনোদিন রচিত হয়নি। গান্ধার শিল্পে বোধিসত্ত্বের মূর্তিতে
ভারতীয় রাজাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকারসজ্জার প্রতিফলন ঘটেছে। তাই নারী-পুরুষের বিচিত্র
ভারতীয় অলংকার, পাগড়ি, শিরোভূষণ, কর্ণালংকার, কণ্ঠহার, মণিবন্ধ ও বাহুর অলংকার স্থাপিত
হয়েছে বোধিসত্ত্বের দেহে। হারিতি, কুবের, যক্ষ, নাগ, গন্ধর্ব, অপ্সরা প্রভৃতি অপ্রধান
ও লোকায়ত দেবদেবীও গান্ধার শিল্পে স্থান পেয়েছে। যেখানে ভারতীয় প্রথাগতভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ,
আসন, মুদ্রা ও দেব-প্রতীকগুলি প্রকাশ পেয়েছে। গান্ধার শিল্পের মূর্তিগুলিতে পাগড়ি,
জামা, ভারী লংকোট, হেলমেট, জুতা প্রভৃতি বিদেশি পোশাক-পরিচ্ছদ দেখা যায়।
গঠনশৈলীর দিক থেকে গান্ধার শিল্প গ্রিক আদর্শে
অনুপ্রাণিত। গান্ধারের মূর্তিগুলিতে স্বভাবানুগ অস্থি ও পেশিগঠিত সহজ মানবদেহবোধকে
প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। শান্ত সমাহিত ভারতীয় মূর্তির আদর্শ ভাস্কর্যে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
গ্রিক দেবদেবীগণ যেন ভারতীয় বেশে উপস্থিত। বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব মূর্তিগুলির পরিপাটি
বসনভূষণ, বস্ত্র, উত্তরীয়ের নিখুঁত ভাঁজ, মাথার কুঞ্চিত কেশদাম, পেশিবহুল বাহু ও বক্ষের
স্বাস্থ্যেজ্জ্বল মহিমা, নানা রত্নখচিত মস্তকাভরণ ও উন্নীষ, চরণে গ্রিস দেশীয় পাদুকা
ইত্যাদি সম্পূর্ণ বৈদেশিক প্রভাবের প্রতিফলন। গান্ধার শিল্পের বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের
পদ্মাসনের পদ্মগুলি অভারতীয় পরিকল্পনা। গান্ধার শিল্পের কোরিন্থীয় ধরনের স্তম্ভশীর্ষ
এবং হারিতি, পঞ্জিকা প্রভৃতি মূর্তিতেও গ্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত। এই জন্যই পার্সি
ব্রাউন গান্ধারকে বলেছেন 'গ্রিক-বৌদ্ধ' শিল্প।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।