প্রশ্ন ঃ ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে সম্রাট অশোকের অবদান মূল্যায়ন করো।
সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় অশোকের
নাম স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তাঁকে কনস্টানটাইন, মার্কাস অরেলিয়াস,
আলেকজান্ডার, মহান আলফ্রেড, জুলিয়াস সিজার, শার্লেম্যান, আকবর, নেপোলিয়ন প্রমুখ ইতিহাসের
উল্লেখযোগ্য নরপতিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন; কিন্তু বাস্তব বিচারে অশোকের কাছে তাঁদের
গৌরব ম্লান হয়ে যায়। পল ম্যালন অরল বলেন যে, কেবলমাত্র ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নরপতি নন-তিনি
পৃথিবীর মহান দার্শনিক নৃপতিদের অন্যতম।
- v যুদ্ধজয়ের পরিবর্তে ধর্মবিজয়:
অশোক যে একজন রণনিপুণ যোদ্ধা ছিলেন,
সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সিংহাসনে আরোহণের অল্পদিনের মধ্যেই তিনি চোল, পাণ্ড্য ও
কলিঙ্গ মিত্রশক্তিকে কলিঙ্গ যুদ্ধে পরাজিত করে মৌর্য সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাবিধান করেন।
এরপর অনায়াসে তিনি সমগ্র দক্ষিণ ভারত নিজ অধিকারে আনতে পারতেন কিন্তু অশোক তা না করে
চিরদিনের মতো যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে শান্তি, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শ প্রচারে
ব্রতী হন। অশোক ধর্মবিজয়ী রাজর্ষি অশোকে পরিণত হন এবং সমগ্র বিশ্বের রাজতন্ত্রের ইতিহাসে
এক নবচেতনার সঞ্চার করেন।
- v নতুন রাজাদর্শ:
বিশ্ব ইতিহাসে সম্রাট অশোকই প্রথম
এক নতুন ধরনের রাজাদর্শ তুলে ধরেন। তিনি রাজপদকে উপভোগ, বিলাস-ব্যসন বা স্বার্থসিদ্ধির
উপায় বলে মনে করতেন না। তাঁর কাছে রাজপদ ছিল জনকল্যাণ ও মানবহিতৈষণার সুযোগ। প্রজাবর্গকে
নিজ সন্তান বলে ঘোষণা করে এবং পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রজাকল্যাণে নিয়োজিত করে জনকল্যাণের
এক নতুন আদর্শ তুলে ধরেন। তিনি নিজেকে প্রজাদের কাছে ঋণী বলে মনে করতেন এবং প্রজামঙ্গলের
মাধ্যমেই এই ঋণ পরিশোধ হতে পারে। অধ্যাপক কোশাম্বীর মতে, এই রাজকর্তব্যের মধ্যে
'Contract Theory' বা 'চুক্তিতত্ত্ব'-এর বীজ নিহিত আছে। এই চুক্তিতত্ত্ব অনুসারে প্রজামঙ্গলের
শর্তেই রাজা তাঁর সিংহাসন লাভ করেছেন।
- v প্রজাবৎসল শাসক:
পিতৃত্ববোধের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত
হলে প্রজাকল্যাণের জন্য তিনি রাজপথ নির্মাণ, রাস্তার দু-পাশে ছায়াপদ বৃক্ষরোপণ, কূপখনন,
পান্থশালা নির্মাণ ও চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। কেবলমাত্র মানুষের জাগতিক কল্যাণসাধনই
নয়-তাদের পারলৌকিক মঙ্গলসাধনে ব্রতী হয়ে তিনি যথার্থ পিতার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
রাজুক, যুত, মহামাত্র, ধর্মমহামাত্র প্রভৃতি রাজকর্মচারীদের ওপর তিনি প্রজাবর্গের ইহলৌকিক
ও পারলৌকিক কল্যাণের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। স্ত্রীজাতির কল্যাণের জন্য তিনি স্ত্রী-অধ্যক্ষ
মহামাত্র নিয়োগ করেন।
- v মানবপ্রেমিক:
তাঁর জনহিতৈষণা কেবলমাত্র নিজ
রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বহির্বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন রাজ্যেও তা সম্প্রসারিত
হয়েছিল। কেবলমাত্র মানুষই নয়-বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় তিনিই প্রথম নরপতি, যিনি পশুপক্ষীর
চিকিৎসা ও মঙ্গলসাধনে ব্রতী হয়েছিলেন। পশুহত্যার পরিমাণ সীমান্বিত করেন। প্রকৃত মানবপ্রেমিক
ও রাজর্ষি অশোক শান্তি-মৈত্রী ও প্রেমের ওপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের পররাষ্ট্র নীতি
প্রবর্তন করেন। ভারত ও ভারতের বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ
হন।
- v বৌদ্ধধর্ম প্রচার:
ভারতের এক ক্ষুদ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ
বৌদ্ধধর্মকে তিনি বিশ্বধর্মে রূপান্তরিত করেন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টার ফলে এশিয়া, ইউরোপ
ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গৌতম বুদ্ধের প্রেম, শান্তি ও সৌহার্দ্যের আদর্শ বিস্তৃত
হয়। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী অশোক ছিলেন যথার্থই পরধর্মসহিষু এবং তাঁর প্রচারিত বৌদ্ধধর্ম
ছিল যথার্থ অর্থে উদার ও সার্বজনীন। ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তিনি মানবধর্মকেই স্থান
দেন। তিনি বলতেন যে, "নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ এবং অপর ধর্মকে নিকৃষ্ট জ্ঞান করা অনুচিত।"
ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, জৈন, আজীবিক সকলেই তাঁর কাছে সমান ছিলেন।
- v সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐক্য স্থাপন:
ভারতীয় ভাষা, সাহিত্য, স্থাপত্য-ভাস্কর্যের
ক্ষেত্রেও তাঁর দান অতুলনীয়। তাঁর ধর্মপ্রচারের ফলে পালি ভাষা সর্বভারতীয় ভাষায় পরিণত
হয় এবং এই ভাষায় গ্রন্থাদি রচিত হতে থাকে। তাঁর আমলে ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপি ভারতের
সর্বত্র প্রচলিত হয়। এইভাবে তিনি ভাষা ও লিপির মাধ্যমে সর্বভারতীয় ঐক্যের আদর্শকে বলবর্তী
করে তোলেন। তাঁর আমলে অসংখ্য স্তূপ, বিহার, চৈত্য, স্তম্ভ নির্মিত হয়। এর ফলে ভারতীয়
শিল্পের ক্ষেত্রেও এক বিবর্তন আসে।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।