প্রশ্ন ঃ মৌর্য শিল্প ও স্থাপত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে
আলোচনা করো। তুমি কি এর মধ্যে কোনো বিদেশি
প্রভাব পরিলক্ষিত করো?
অথবা, মৌর্যযুগে স্থাপত্য-ভাস্কর্যের কতটা
উন্নতি ঘটেছিল এবং এতে কি কোনো রকম বিদেশি প্রভাব পড়েছিল?
অথবা, মৌর্যযুগের
শিল্পকলা সম্পর্কে যা জানো লেখো। মৌর্য শিল্পকলায় পারসিক প্রভাব কতটা লক্ষ করা যায়?
ভারতীয় স্থাপত্য-ভাস্কর্যের প্রকৃত
সূচনা হয় মৌর্যযুগ থেকে। মৌর্য শিল্প গড়ে ওঠে বিশাল ও বহু সংস্কৃতিভিত্তিক এক অভূতপূর্ব
সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায়। তবে কেবল রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সম্পদের প্রতুলতার জন্যই মৌর্য
শিল্প গড়ে উঠেছিল একথা ঠিক নয়। শিল্পবিকাশের পেছনে গ্রিক ও পারসিক প্রভাব সক্রিয় ছিল
বলে এক শ্রেণির পন্ডিত মনে করেন। প্রাসাদ, স্তূপ, বিহার, চৈত্যগ্রহ, স্তম্ভ মৌর্যযুগের
প্রধান স্থাপত্যকীর্তি।
- v রাজপ্রাসাদ:
মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে পাটলিপুত্রের
রাজপ্রাসাদ সম্পর্কে জানা যায়। কাঠের তৈরি সুবিশাল এই প্রাসাদের থামে সোনা-রূপোর পাত
লাগানো ছিল এবং এই থামগুলিতে বেষ্টন করে ছিল সোনার তৈরি লতা ও খোদাই করা রুপোর পাখি।
পাটলিপুত্রের দুর্গের প্রাচীরটি ছিল কাঠের তৈরি, তাতে 64টি সিংহদরজা এবং 570টি তোরণ
ছিল। সম্রাট অশোকের প্রাসাদও ছিল আরও বিশাল ও পাথরের তৈরি। চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন অশোকের
প্রাসাদ দেখে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেন যে, প্রাসাদটি কোনো মানুষের তৈরি নয়, বরং কোনো
দানবের কীর্তি। কেবলমাত্র বিশালতা নয় প্রাসাদ নির্মাণে ব্যবহৃত পাথরের মসৃণতাও এর অন্যতম
বৈশিষ্ট্য। এই প্রাসাদে ব্যবহৃত পাথরগুলি অসম্ভব মসৃণ এবং আয়নার মতো ঝকঝকে। সাম্প্রতিক
খননকার্যের ফলে পাটনা শহরের কাছে কুমারাহার নামক স্থানে এই প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এবং
শত স্তম্ভবিশিষ্ট একটি দরবার কক্ষ আবিষ্কৃত হয়েছে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, ভারতীয়
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পে পাথরের ব্যবহার অশোকের আমল থেকেই শুরু হয়।
- v স্তূপ:
মৌর্য স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন
হল স্তূপ। কোনো বিখ্যাত ঘটনা, পবিত্র স্থান বা কারো দেহাবশেষ সুরক্ষিত রাখার জন্য বৌদ্ধ
ও জৈনরা ইট ও পাথর দিয়ে স্তূপ নির্মাণ করত। বৌদ্ধগ্রন্থ 'মহাবংশ' থেকে জানা যায় সম্রাট
অশোক 84000 টি স্তূপ নির্মাণ করেন। কালের প্রকোপে আজ এর সামান্যই টিকে আছে। বর্তমান
মধ্যপ্রদেশের ভূপালের কাছে সাঁচি স্তূপটির কথা বলা যায়। এটি আয়তনে 122 ফুট এবং উচ্চতায়
78 ফুট। চারটি প্রেরণদ্বারসহ স্তূপটি 11ফুট উচ্চতায় রেলিং দিয়ে ঘেরা। সম্রাট অশোকের
আমলে স্তূপটি ইট দিয়ে তৈরি হয়। পরবর্তী একশো বছরে এর আয়তন প্রায় দ্বিগুণ হয় এবং এতে
পাথরের ব্যবহার লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ঠিক একই রকম একটি স্তূপ সারনাথে পাওয়া গেছে।
- v চৈত্য :
এই যুগের চৈত্যগুলি মৌর্য স্থাপত্যের
অন্যতম নিদর্শন। চিত হল ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্মিত কৃত্রিম গুহা বা উপাসনাকক্ষ। এগুলি
পাহাড় কেটে নির্মিত হত। সাঁচি, সারনাথ এবং গয়ার ষোলো মাইল দূরে বরাবর পাহাড়ে অশোক নির্মিত
স্তূপ মিলেছে। এগুলি অজীবিক সম্প্রদায়ের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিল। গুহাগাত্র ছিল মসৃণ
ও চকচকে।
- v শুভ:
মৌর্য শিল্পকলা বা ভাস্কর্যের অসাধারণত্ব
প্রকাশিত হয়েছে অশোকের আমলে নির্মিত ধূসর রঙের বেলেপাথরে তৈরি স্তম্ভগুলিতে। বাখিরা,
রামপূর্বা, লৌরিয়া নন্দনগড়, রুম্মিনদেই, সারনাথ, সাঁচি, ফারুখাবাদ প্রভৃতি স্থানে অশোকের
আমলে প্রায় ত্রিশটিরও বেশি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল। এই স্তম্ভগুলি কোনো স্থাপত্যের অঙ্গ
হিসেবে স্থাপিত হয়নি। একারণে এগুলি ভাস্কর্যের নিদর্শন হিসেবেই স্বীকৃত।
প্রতিটি স্তম্ভের দুটি অংশ-একটি
দন্ড এবং অপরটি বোধিকা বা শীর্ষ। দণ্ডটি একশিলা অর্থাৎ একখন্ড পাথুরে নির্মিত। গোলাকার
স্তম্ভ নীচে থেকে ক্রমশ সরু হয়ে সোজা ওপরে উঠে গেছে। দণ্ডগুলির উচ্চতা 30-32 ফুট। দণ্ডগুলির
নীচের ব্যাস 30-32 ইঞ্চি এবং মাথার ব্যাস 25-27 ইঞ্চি। বৃহত্তম দণ্ডটির ওজন 50 টনের
মতো। দণ্ডগুলির মসৃণতা ছিল বিস্ময়কর। দন্ডের ওপরে একটি তামার খিল দিয়ে বসানো একটি পৃথক
অখন্ড পাথর যাকে শীর্ষদেশ বলা হত। এই শীর্ষদেশ বা বোধিকার তিনটি অংশ। নীচে ঘণ্টার আকারে
ওলটানো পদ্ম। পদ্মের পাপড়িগুলি তক্ষণ শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন। এর ওপর গোলাকার বা আয়তাকার
একটি মঞ্চ। মঞ্চের চারপাশে লতাপাতা ও পশুপাখির অপূর্ব অলংকরণ। এর ওপরে স্তম্ভশীর্ষে
আছে পশুপতি, যেমন-সিংহ, বৃহ, হস্তি, অশ্ব প্রভৃতি। এই মূর্তিগুলি ভাস্কর্য শিল্পের
অনন্য নিদর্শন। অশোকের স্তম্ভগুলির মধ্যে সারনাথের স্তম্ভটি সর্বশ্রেষ্ঠ। স্যার জন
মার্শাল বলেন যে, মঞ্চের উপর স্থাপিত পশুমূর্তিগুলিতে ভাস্কর্য-শিল্পের যে নিদর্শন
পাওয়া যায়, তার সমকক্ষ শিল্পসৃষ্টি পৃথিবীর আর কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি।
- v বিদেশি প্রভাব/মৌর্য শিল্পকলার প্রকৃতি:
মৌর্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পে
বিদেশি প্রভাব কতটা কাজ করেছে এ প্রশ্নে পন্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। জন মার্শাল
মনে করেন, পাটলিপুত্রে অশোকের রাজপ্রাসাদ ও সারনাথের স্তম্ভের ওপর পারসিক ও গ্রিক শিল্পরীতির
প্রভাব কাজ করছে। প্রথমটি পারস্য সম্রাট প্রথম দরায়ুসের আবাদান প্রাসাদের অনুকরণ।
স্তম্ভটি নির্মিত হয়েছিল পারসিক ভাস্কর্যের আদলে। আলেকজান্ডারের প্রাচ্যদেশ অভিযানের
ফলে গ্রিক ও পারসিক শিল্পরীতির মধ্যে সমন্বয় গড়ে ওঠে। অশোক এই শিল্প আদর্শে প্রভাবিত
ব্যাকট্রিয় গ্রিক শিল্পীদের ভারতে আমন্ত্রণ জানান। তাঁরাই ছিল মৌর্য ভাস্কর্যের স্রষ্টা।
অপরদিকে
হ্যাভোল ও কিছু ভারতীয় শিল্পের সমালোচক বিদেশি প্রভাবের তত্ত্ব মানেন না। হ্যাভোল মনে
করেন মৌর্য স্থাপত্য আর্য-অনার্য শিল্পরীতির সংমিশ্রণ। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদগণের
মতে ভারতীয় শিল্পরীতিই মধ্য এশিয়া ও চিনের শিল্পরীতিকে প্রভাবিত করেছিল। মৌর্য স্তম্ভের
ওপর পারসিক প্রভাব থাকলেও মৌর্য স্তম্ভগুলি আকার ও পরিকল্পনায় স্বাতন্ত্র্য ছিল। পারসিক
স্তম্ভের একটি ভিত্তিমূল ছিল যা অশোকের স্তম্ভের ছিল না। পারসিক স্তম্ভের দন্ড অনেক
পাথরের সমষ্টি, কিন্তু অশোকের স্তম্ভগুলি একশিলা। শিল্প-বিশেষজ্ঞ নীহাররঞ্জন রায় মৌর্য
শিল্পে ভারতীয়দের অদানের ওপর জোর দিয়েছেন। আনন্দ কুমার স্বামী মন্তব্য করেছেন, ভারত
ও পারস্য উভয়ই ছিল পশ্চিম এশিয়ার সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশীদার।
শিল্প-বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন মৌর্য-স্থাপত্য,
ভাস্কর্য ছিল দরবারি চরিত্রের। এর উদ্দেশ্য ছিল জাঁকজমক ও আড়ম্বর প্রদর্শন করে মৌর্যরাজাদের
প্রতি প্রজাবর্গের শ্রদ্ধা ও সমীহ আদায় করা। বৃহত্তর জনসমষ্টির সঙ্গে এই শিল্পকর্মের
কোনো সংযোগ ছিল না। মৌর্য সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির সঙ্গে এই শিল্পকর্মের কোনো সংযোগ ছিল
না। মৌর্য সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির সঙ্গে এই শিল্পকর্মের সমৃদ্ধি ও তার পতনের সঙ্গে এর
পতনের যোগাযোগ ছিল। ভারতের পরবর্তী শিল্পরীতির সঙ্গে মৌর্যশিল্পের বিশেষ কোনো সম্পর্ক
ছিল না।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।