প্রশ্নঃ বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের একটি চিত্র অঙ্কন করো।
অথবা, বাংলা ভাষার যুগ বিভাজন উল্লেখ
করে তার বিবর্তনের রূপরেখা চিহ্নিত করো।
বাংলা ভাষা আজ পৃথিবীর মধ্যে
সবচেয়ে মধুরতম ভাষা। এ ভাষাতেই লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র,
রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রহমান প্রমুখ। বঙ্গজননীর কোলে বিবিধ
রতন জন্মগ্রহণ করেছে কালে কালে। এ ভাষা হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন। দশম শতাব্দী থেকে
আজ পর্যন্ত নদীর মতো প্রবাহিত হয়ে চলেছে বাংলা ভাষা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে প্রাচীন
ভারতীয় আর্যভাষা হয়ে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষায় এসে আমরা অনেকগুলি স্তর পেয়েছিলাম। যথা-প্রাকৃত,
অপভ্রংশ, অবহট্ট। এগুলির আবার স্থানিক ভেদে নানান ভাগ ছিল। মাগধী অবহট্ঠ থেকেই দশম
শতাব্দীতে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল।
বাংলা ভাষার জন্ম দশম শতাব্দী
না তারও আগে-এ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন,
দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই বাংলা ভাষার জন্ম। সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে আমরা
পেলাম চর্যাপদকে। দশম শতাব্দী থেকে আজকের বাংলা ভাষাকে আমরা তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে
থাকি। যথা-প্রাচীন বাংলা, মধ্য বাংলা ও আধুনিক বাংলা। প্রাচীন বাংলার সময়পর্ব দশম থেকে
দ্বাদশ শতাব্দী, সাহিত্যিক নিদর্শন 'চর্যাপদ'। এ ছাড়াও রয়েছে বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দের
‘টীকাসর্বস্ব' ও হলায়ুধের 'সেক শুভোদয়া' গ্রন্থে সংকলিত কিছু ছড়া, গান। মূলত চর্যাপদকে
ধরেই এই যুগের যুগগত বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করা সম্ভব। যেমন, ছন্দের কথাই ধরা যাক। প্রাচীন
বাংলার ছন্দ ছিল পাদাকুলক ছন্দ। সেখান থেকে আদি-মধ্যযুগে এলো ষোড়শ মাত্রিক পয়ার, সেখান
থেকে অন্ত্য-মধ্য বাংলায় চতুর্দশ অক্ষরের পয়ার, সেখান থেকে আধুনিক যুগে অমিত্রাক্ষর,
গৈরিশ ছন্দের পাশাপাশি গদ্যছন্দেরও বিকাশ লক্ষ করা যায়। আবার শব্দভান্ডারের ক্ষেত্রেও
বিপুল পরিবর্তন আসে। আদি-মধ্যযুগে সংস্কৃত 'গন্ধি' শব্দের ব্যবহার ছিল, সেখানে অন্ত্য-মধ্য
বাংলা থেকেই বিভিন্ন বিদেশি শব্দ প্রবেশ করে বাংলাকে একটি মিশ্র শব্দের মতো তৈরি করে
ফেলে।
মধ্য বাংলার সময়পর্ব ১৩৫০
খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ, মতান্তরে ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর সময় (১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ)
পর্যন্ত। একটি বিষয় হল, দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রাচীন যুগের শেষ আর ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি
সময়ে মধ্যযুগের সূচনা। এই দেড়শো বছর বাংলাদেশে ছিল তুর্কি আক্রমণ। ফলে সমাজ ও সাংস্কৃতিক
জীবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, ফলে কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাই এই
পর্ব অন্ধকারময় যুগ। মধ্যযুগের আবার দুটি ভাগ-আদি-মধ্যযুগ ও অন্ত্য-মধ্যযুগ। আদি মধ্যযুগের
সময়পর্ব ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ। সাহিত্যিক নিদর্শন 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'।
অন্ত্য-মধ্যযুগের সময়পর্ব ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০ বা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ। সাহিত্যিক
নিদর্শন 'বৈষুব পদাবলি', 'মঙ্গল-কাব্য', 'শাক্ত পদাবলি'। এই পর্বে এসে প্রাচীন বাংলার
বহু বৈশিষ্ট্য লোপ পায়। বহু বিদেশি শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করে। পূর্বের ধ্বনিগত
বৈশিষ্ট্যগুলি বহু ক্ষেত্রেই লোপ পাওয়া শুরু করে।
আর আধুনিক যুগের সূচনা ইংরেজদের
আগমনের পর থেকে অর্থাৎ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এই পর্বে এসে গদ্যভাষার জন্ম হয়। সাহিত্যের
ভাষা হিসেবে গদ্যের জন্ম এই পর্বের বড়ো নিদর্শন। সেই গদ্যেরও আবার দুটি রূপ আমরা পেলাম,
যথা-সাধু ও চলিত। ক্রমে চলিত গদ্যই প্রাধান্যলাভ করে। এ যুগের সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে
আমরা পেলাম গদ্যসাহিত্য (প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটোগল্প), কবিতা ও নাটক। লেখকদের মধ্যে
আমরা পেলাম বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসুদন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ও অন্যান্য
বহু লেখক, কবি ও কথাকারদের। এই তিনটি যুগের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা আধুনিক হয়ে উত্তর
আধুনিক যুগে এগিয়ে চলেছে।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।