প্রশ্ন- প্রাচীন ভারতে যোগবিদ্যা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

Nil's Niva
0

প্রশ্ন- প্রাচীন ভারতে যোগবিদ্যা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।

*****************************************

উত্তরঃ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর ২১শে জুন আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালিত হচ্ছে। যোগের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতার জন্য জ্ঞানের অগ্রগতিতে ভারতের অবদানকে চিহ্নিত করতে এই দিনটি পালিত হয়। সারা বিশ্বে এই ক্ষেত্রে ভারতের প্রাচীন জ্ঞান এখন স্বীকৃত হয়েছে।

'যোগ' হল একটি সাংস্কৃতিক শব্দ, যার অর্থ 'যোগ বা একত্রিত করা'। এই 'যোগ' দেহ ও চেতনার মিলনের প্রতীকস্বরূপ। এটিকে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার একটা প্রাচীন বিজ্ঞান বলে মনে করা হয়। কারণ মানসিক একাগ্রতা এবং শারীরিক কার্যকলাপ-উভয় নীতিই হল এর ভিত্তি। 'যোগ' বলতে একটা দর্শন এবং জীবন-যাপন পদ্ধতি উভয়কেই বোঝায়। এটা হল প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ছয়টি ধারার (ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, পূর্ব-মীমাংসা এবং বেদান্ত বা উত্তর মীমাংসা) মধ্যে অন্যতম যোগ দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত। যোগ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পতঞ্জলি। তিনি 'যোগসূত্র' রচনা করেছিলেন। এটি প্রায়শই সাংখ্য দর্শনের সাথে একত্রিত করা হয় এবং উভয়কেই একটি সম্বন্ধযুক্ত ব্যবস্থা বলা হয়। কিন্তু সাংখ্য অনেক বেশি আত্মার তাত্ত্বিক উপর ভিত্তি করে আছে, অন্যদিকে যোগ ভিত্তি করে আছে শারীরিক ও মানসিক অনুশীলনের ব্যবহারিক জ্ঞানের উপর, যা আত্মাকে চূড়ান্ত মুক্তির দিকে পরিচালিত করে। যোগসূত্র ছাড়াও যোগের উল্লেখ অনেক প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। যেমন-বেদ, উপনিষদ, ভগবৎগীতা, পুরাণ এবং বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থসমূহ।

প্রাচীন সূত্র সমূহের সবকটিই যোগের দুটো দিকের রূপরেখা প্রদান করে-আধ্যাত্মিক দিক এবং ব্যবহারিক দিক। যোগের আধ্যাত্মিক দিক হল ধ্যান এবং সঠিক পথের মাধ্যমে নিজেকে ঈশ্বরের সাথে একত্রিত করা। গীতায় এর তিনটি পথের কথা বলা হয়েছে-জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এবং কর্মযোগ। বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মও একটা বিশুদ্ধ ও উৎসর্গীকৃত জীবনযাপনের জন্য এবং প্রকৃত জ্ঞানের জন্য যোগের গুরুত্বকে স্বীকার করে। বুদ্ধ এবং মহাবীর উভয়েই জ্ঞান অর্জনের জন্য বছরের পর বছর ধরে কঠোর ধ্যান করেছিলেন। তাঁরা প্রকৃত অর্থেই যোগী ছিলেন। কারণ তাঁরা তাঁদের ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন এবং দুঃখের বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সিন্ধু সভ্যতার সময়ও যোগাভ্যাস প্রচলিত ছিল বলে মনে করা হয়। হরপ্পীয় আমলের কিছু সীলমোহর পাওয়া গেছে, যেগুলোর মধ্যে একটিতে একজনকে যোগাসন ভঙ্গীতে বসে থাকতে দেখা যায়, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'পশুপতি' বা 'আদি-শিব'।

যোগের ব্যবহারিক দিকটিই বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষের আগ্রহের বিষয়। সমস্ত চিকিৎসক একটা সুস্থ জীবনের জন্য 'যোগ' করার এবং এর নিয়মসমূহ পালন করার পরামর্শ দেন। তাই 'যোগ' আজ কিছু ধরনের শারীরিক অনুশীলনের সমার্থক হয়ে উঠেছে। যদিও যোগের প্রাচীন গ্রন্থ যোগসূত্রে বর্ণিত এর মূল বিষয়গুলি এ'থেকে পৃথক।

যোগসূত্রে বলা হয়েছে, যোগ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অনুশীলনের মাধ্যমে মানসিক এবং শারীরিক নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পর্কিত। যোগের লক্ষ্যের যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল, সেটি হল মনের সমস্ত স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়াকলাপের ইচ্ছাকৃত বিরতি, যা প্রকৃতিগতভাবে বাতাসের দ্বারা ভেঙে যাওয়া পুকুরের উপরিতলের মত অবিরাম আন্দোলিত হতে থাকে। এটি যাতে স্থির থাকে, তার জন্য চাই বাইরে থেকে আসা সমস্ত ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং ভিতরে থেকে আসা সমস্ত উদ্দীপনাগুলির দ্বার রুদ্ধ করা। মনে করা হয়, যখন এইরূপ ব্যবস্থা অর্জিত হয়, তখনই একমাত্র ঈশ্বর প্রকাশিত হন।

যোগ দর্শনে 'অষ্টাঙ্গিক মার্গ' (আটটি পথ) অনুশীলনের উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এগুলি হল- 

যম- এটা হল যোগের প্রথম নীতি। এর দ্বারা বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ ইন্দ্রিয়গুলিকে আত্ম-নিয়ন্ত্রিত করা হয়। বলা হয়, অহিংসা, সত্য, 'আস্তেয়' (অন্যের সম্পদ কামনা না করা), 'ব্রহ্মচর্য' (পার্থিব আনন্দ থেকে দূরে থাকা) এবং 'অপরিগ্রহ' (অত্যধিক সম্পদ সংগ্রহ না করা) অনুসরণের মাধ্যমে 'যম' পালন করা যেতে পারে। যোগের মাধ্যমে বৃহত্তর সুবিধা অর্জনের জন্য এগুলি হল প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ। সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও এই নিয়মগুলির উল্লেখ আছে।

নিয়ম- এটা হল যোগের দ্বিতীয় নীতি। এটা অহংবোধকে কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় আচরণের বিভিন্ন বিধির রূপরেখা প্রদান করে। বলা হয়েছে, 'শৌচ' বা বিশুদ্ধতা, 'সন্তোষ' বা তৃপ্তি, 'তপস' বা তপস্যা, 'স্বাধ্যায়' বা স্ব-অধ্যয়ন এবং 'ঈশ্বর প্রণিধান' বা ঈশ্বরের ধ্যান-এই পাঁচটি সৎ আচরণ অনুসরণ করে এটি অর্জন করা যেতে পারে।

আসন- যোগের পরবর্তী ধাপ হল আসন, যার অর্থ শরীরকে সঠিক ভঙ্গীতে রাখা। এই ধাপে মন এবং শরীর উভয়কেই স্থির রাখতে হয়। এটাকে যোগাসনও বলা হয়, যার দ্বারা শরীর সুস্থ হয়ে ওঠে এবং যোগাসনকারীর নিয়ন্ত্রণে আসে।

প্রাণায়াম- এরপর আসে প্রাণায়াম। প্রাণায়াম হল গভীর শ্বাস নেওয়া, শ্বাস আটকে রাখা বা ছেড়ে দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা। এটা একজন যোগ শিক্ষকের নির্দেশনায় করা উচিত। প্রাণায়াম ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং মন ও শরীরকে শক্তি প্রদান করে।

প্রত্যাহার- এর উদ্দেশ্য হল ইন্দ্রিয়কে বাহ্যিক আনন্দ থেকে দূরে রাখা এবং মনে উপর নিয়ন্ত্রণ আয়ত্ত্ব করা।

ধ্যান- ধ্যান হল একটি লক্ষ্য সম্পর্কে নিয়মিত চিন্তন। এটা আরাধ্য লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে সাহায্য করে, যা অবশ্যই সৎ প্রকৃতির হতে হবে।

সমাধি- এটি যোগের শেষ ধাপ, যখন মন চিন্তার লক্ষ্যের সঙ্গে মিশে যায় এবং যোগী তাঁর মন, শরীর এবং ইন্দ্রিয়কে জয় করতে সক্ষম হয়। এইভাবে, যোগের উদ্দেশ্য অর্জিত হয়। পতঞ্জলির যোগসূত্রে যেভাবে যোগের অর্থ সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা হয়েছে, 'যোগ হল মনের ওঠানামাকে শান্ত করা'।

যোগের প্রথম পাঁচটি ধাপ হল ধর্ণা, ধ্যান এবং সমাধিতে পৌঁছানোর প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ, যা প্রকৃতপক্ষে যোগের সাথে সম্পর্কিত, যার অর্থ কাঙ্খিত লক্ষ্যের সাথে যোগদান বা একত্রিত হওয়া। যোগ দর্শনে সর্বশেষ কাঙ্খিত বস্তু হল 'মোক্ষ' বা ইন্দ্রিয়ের বন্ধন থেকে মুক্তি।

প্রাচীন যুগে, আয়ুর্বেদের সাথে যোগকে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার অনুশীলন হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। আজ এগুলির উপকারিতা সারা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত হয়েছে।

সমস্ত প্রাচীন চিকিৎসা-বিজ্ঞানীরাও রোগ প্রতিরোধে এবং মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে যোগের তাৎপর্য স্বীকার করেছেন। বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি আজ জনসাধারণকে যোগের প্রাথমিক পাঠ দিচ্ছেন। তাঁরা শারীরিক সুস্থতার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রাণায়াম এবং যোগাসন প্রদর্শন করছেন।



জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার

তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি

অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
bookstore