ভাওয়াইয়া
ভাওয়াইয়া নামকরণে নানা মত প্রচলিত, কেউ বলেন, 'ভাও' শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া, কারও মতে 'বাউদিয়া' থেকে ভাওয়াইয়া, কারও মতে, ভাওয়া (নীচু) অঞ্চলের গান বলে ভাওয়াইয়া, অন্যমতে বাওয়াইয়া (ভেসে আসা অর্থে) আসা গান বলে উচ্চারণ বিকৃতিতে ভাওয়াইয়া, কেউ দাবি করেন গভীর নিশীথে রাজবংশী রমণীর 'ভাউলে'য় (ছোটো নৌকা) করে প্রেম নিবেদন থেকে ভাওয়াইয়া নামকরণ হয়েছে। বস্তুত ভাবযুক্ত জনরব পরবর্তী ভাবোচ্ছ্বাসের কথা ও সুরের সমন্বয়ে ভাওয়াইয়া সংগীতের রূপ নিয়েছে।
ভাওয়াইয়া গানের জাদুকর আব্বাসউদ্দীন-এর মতে, এই গান উত্তরবঙ্গ তথা কোচবিহারের নিজস্ব সম্পদ। উদার হাওয়ার মতো-এর সুরের গতি, তার এই নাম ভাওয়াইয়া।
আবার ভাওয়াইয়ার একনিষ্ঠ সুর-সাধক প্রয়াত সুরেন রায় বসুনিয়া-র অভিমতটিও বহুল প্রচলিত- "ভাবপূর্ণ যে গীত মানুষকে ভাববিহ্বল করে দেয় তাই ভাওয়াইয়া"।
দোতারার ডাং আর ভাওইয়া গান
পাগল কইরচে ঐ কইনার মন।
ভাওয়াইয়া গানের ক্ষেত্রটি বিস্তৃত। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং জেলার সমভূমি, পশ্চিম দিনাজপুর জেলার উত্তরাংশ, বর্তমান বাংলাদেশের পূর্বতন রংপুর জেলা, দিনাজপুর জেলার কিছু অংশ-আসামের গোয়াপাড়া ও ধুবড়ী জেলা-এই বিস্তৃত জনপদের সংগীত ভাওয়াইয়া। বলা চলে সর্বাধিক জনপ্রিয় একক সংগীত। দোতারা সহযোগে গীত হয়।
ভাওয়াইয়ার যা একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তা হল এক স্বর থেকে অন্য স্বরে যাওয়ার সময় ধ্বনিবিয়োগের সঙ্গে যে একটি বিচিত্র ধরনের মোচড় শোনা যায়-যাকে হঠাৎ গলা ভেঙে যাওয়া মনে হয়। এর কারণ ওই গানের বিস্তারভুবন প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং অবশ্যই গায়ক-গায়েন অর্থনৈতিক শ্রেণি-অবস্থান।
ভাওয়াইয়া গানের পটভূমির মোটামুটি দুটি শ্রেণিবিভাগ, বাংলাদেশের অংশ মোটামুটি সমতল, পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গের অংশগুলি অনেকটাই তরাই, পর্বতাঞ্চলের সীমানাভুক্ত। এই অঞ্চলের অরণ্যে-প্রান্তরে খরস্রোতা সীমানাভুক্ত। এই অঞ্চলের অরণ্যে-প্রান্তরে খরস্রোতা নদীগুলির পরিবেশে মুক্তকণ্ঠে গান গাইবার সময়, স্তরের একটা বিশেষ ঝোঁক পড়ে, শিল্পীরাও সেই ঝোঁকের সঙ্গে মানানসই করেই সুর সৃষ্টি করেন। সেই সুরই প্রাকৃতিক পরিবেশের অনুষঙ্গে গলা-ভাঙাতে রূপ পেয়েছে।
কোচবিহার, জলপাইগুড়িতে স্বাভাবিক তৃণসমৃদ্ধির জন্য মহিষ চরানোটা একটি মুখ্য উপজীবিকা। রংপুরে-দিনাজপুরের মানুষেরাও মহিষের গাড়ি চালিয়ে জীবিকা অর্জন করেন। গাড়ি চলার ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে স্বরের কম্পন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে যায়। উপলক্ষ্যটা পৃথক হলেও এই গানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যটুকু এখানে অটুট থাকে। ভাওয়াইয়া গানের একটি বিশেষ লক্ষণ কারুণ্য। একটা বিরহের ভাব-কথায় ও সুরে প্রভাব বিস্তার করে। গাড়োয়াল মৈষাল বন্ধুকে ছেড়ে থাকার কষ্টটাই আবেগের সঙ্গে ব্যক্ত হয়-
ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়ারে।।
অথবা, তুমি যদি যাত্তরে মইশাল
কাঁইদবে আমার হিয়া
ঘাড়ের গাছমা দিয়া যাও
থাকিম বুকে দিয়ারে
প্রাণ কান্দে মৈষলে বন্দুরে।
ভাইয়াইয়া গানের প্রধান বিষয়বস্তু মানবিক প্রেম। প্রেম-বিরহের প্রকাশ এর অবয়বকে ঘিরে রয়েছে। কথা ও সুরের এমন আশ্চর্য মেলবন্ধন বাংলার ভাটিয়ালি ছাড়া আর কোনো সংগীতে পাওয়া যায় না। মানুষের প্রেম অনুভূতি, গভীরতা, ব্যঞ্জনা, বিরহ-কাতরতা এ সংগীতকে মাধুর্যদান করেছে। প্রেমে যার শুরু, প্রেমে যার পথ চলা, বিরহে যেন তার অনিবার্য পরিণতি। এ প্রেম চিরন্তন। দৈহিক সম্পর্ক থেকে এ প্রেম ভিন্ন। এই সংগীতের প্রেমের কেন্দ্রবিন্দু হল নারী, গ্রামীণ নারীর না মেটা আশা ও বেদনা অর্থাৎ নারী মনের নৈরাশ্যই এর মূল বিষয়। তাই ভাওয়াইয়া গানের সুর এত মর্মস্পর্শী ও বেদনাবিধুর।
ভাওয়াইয়া গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার বিশেষ কথার ওপর ঝোঁক দেওয়া, ছন্দের সঙ্গে সংগতি রেখে এই ঝোঁক বা জোর দেওয়া হয়, ফলে শব্দের উচ্চারণেও তার প্রতিফলন ঘটে। ভাওয়াইয়া গানের দ্বৈত সংগীত ও একক সংগীতের ন্যায় পরিবেশন করা হয়। দ্বৈত সংগীত দুজনের মধ্যে-একজন একটি অংশ গান করলে বাকিজন অন্য অংশ করে, কিন্তু ভাওয়াইয়ার একই ব্যক্তি সম্পূর্ণ গানটি করেন। এ ছাড়া নারীমনের ভাবসমৃদ্ধ সংগীতও পরিবেশিত হয় পুরুষ কণ্ঠে। মূলত প্রথম অবস্থায় নারীকণ্ঠের কোনো সংগীতেরই প্রচলিত ছিল না রাজবংশী সমাজে; কারণ মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর উচ্চস্বরে গান করার কোনো অনুমতি পাওয়া সম্ভব ছিল না তখন। তাই অধিকাংশ ভাওয়াইয়া গানই পুরুষ কণ্ঠে গীত হয়।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।