ভাটিয়ালি
*****************************************
লোকসংগীতের মধ্যে বাংলার ভাটিয়ালি গান খুবই জনপ্রিয়। 'ভাটিয়ালি' একটি সূর। এই ভাটিয়ালি গান শুধু মাঝি-মল্লারাই করেন না। এই গান সাধারণত গ্রামের সকলের মুখেই শোনা যায়।
বাংলা লোকসংগীতের একটি উল্লেখযোগ্য শাখা হল ভাটিয়ালি। এই গান মূলত পূর্ববাংলার গান। পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি প্রভৃতি অঞ্চলে এই গান প্রচলিত দেখা যায়। আসলে ভাটিয়ালি শুধু একটি সংগীতের ধারাই নয়। ভাটিয়ালি ওই অঞ্চলের একটি মুখ্য সুর হিসেবে পরিচিত।
'ভাটি' শব্দটিকে কেন্দ্র করে ভাটিয়ালি গানের উৎপত্তি হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ভাটির চলমান স্রোতের ওপর নৌকার পালে বাতাস লাগিয়ে মাঝিরা যে গান গায় তাই 'ভাটিয়ালি গান' নামে পরিচিত। বিস্তীর্ণ নদীর দিগন্ত প্রসারী শূন্যতার বুকে একাকী মাঝির নির্জন একাকীত্ব মোচনের গান ভাটিয়ালি। এ গানে মূর্ত হয়ে ওঠে একাকী মাঝির অবসরযাপনের মুহূর্তগুলি। দিনান্তের কর্মক্লান্ত শরীরের বিশ্রামের সময় ভাটিতে নৌকো ছেড়ে যাওয়া মাঝির আত্মনিবেদনের আকৃতি বা ফেলে আসা প্রেমিকের কথা ভেসে ওঠে এই গানের মধ্য দিয়ে। প্রবহমান উদার নদীর বুকে নিঃসঙ্গ মাঝি মাথার উপর সীমাহীন উন্মুক্ত আকাশের নৈসর্গিক পরিবেশে ভাববিহ্বল হয়ে পড়ে, তার মনের রুদ্ধদ্বার খুলে গিয়ে প্রকাশিত হয় গানের সুর।
ভাটিয়ালি নদীর গান হলেও কখনো-কখনো এই গানের সুরের অপ্রতিরোধ্য প্রভাবের ঢেউ গিয়ে পড়ে উন্মুক্ত প্রান্তরের চাষি এবং রাখালের কণ্ঠেও। এই গানের রচয়িতা মাঝিরা এবং শ্রোতাও সম্ভবত তারাই। গানের মধ্যে একটা সহজ-সরল আবেদন লক্ষ করা যায়। সর্বোপরি ভাটিয়ালির মধ্যে নেই কোনো কৃত্রিমতা; ওস্তাদের মারপ্যাঁচ এখানে অচল। প্রাণের সহজ, স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে সরল বাণীরূপে ও সুরের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এই গান মাঝির অবচেতন মনের জীবনজিজ্ঞাসা।
ভাটিয়ালি গানের বিষয় দুটি-প্রেম ও ঈশ্বর। একদিকে লৌকিক প্রেমচেতনা অন্যদিকে আধ্যাত্মিক ঈশ্বর চেতনা। মাঝিরে দৈনন্দিন বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, স্নেহ- প্রীতির প্রকাশ ঘটলেও কখনো-কখনো আধ্যাত্মিক জীবনের কথাও ফুটে ওঠে এই শ্রেণির গানের মধ্য দিয়ে। 'মন মাঝি তোর বৈঠানেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না।' গানটিতে ইহলৌকিক জগতের সঙ্গে পারলৌকিক জগতের মেলবন্ধন ঘটতে দেখা যায়। বাউলের 'মনের মানুষ' ভাটিয়ালিতে 'ভবনদীর মাঝি'তে রূপান্তরিত হয়েছে। ভাটিয়ালি গানের নায়ক 'সুজন নাইয়া' জীবনতরীর কর্ণধারও তিনি। বাউল গানের মতোই দৈনন্দিন জীবনের সাংসারিক কথাবার্তার মাধ্যমে আধ্যাত্মবাদ প্রকাশ পেয়েছে নীচের গানটিতে-
ওরে সুজন নাইয়া
ক্যামনে যাবি ভবনদী বাইয়া...।
ভাটিয়ালি তালবিহীন, উদাসীনতার এবং দ্রুতলয়ের সম্প্রসারিত গান। এই গানের সঙ্গে কোনো যন্ত্র ব্যবহৃত হয় না। এ গান অপরকে শোনাবার প্রয়োজনে নয় এবং কোনো ব্যস্ততার অপেক্ষা রাখে না। তাই মাঝির কণ্ঠনিঃসৃত এই গান ছন্দের বন্ধনহীন, সুরকে চঞ্চল করে না। সুর তার স্বচ্ছন্দ গতিতে মাঝির মনের কথার দু-একটি শব্দগুচ্ছে দীর্ঘ ঢেউয়ের পথে দিগন্তে পাড়ি জমায়। বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে ভাটিয়ালির এই নিবিড় অন্তরঙ্গতা আমাদের হৃদয়তন্ত্রীকে সুরের ঝর্ণাধারায় সিক্ত করে এবং পরম এক উদাসীনতা নিয়ে উপস্থিত হয়।
এই গানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
১. দু-তিনটি শব্দ নিয়ে একটি শব্দগুচ্ছ এক একবারে উচ্চারিত হয়।
২. এই উচ্চারণের পরেই থাকে একটা লম্বা টান। সাধারণভাবে দেখা যায়, শব্দগুচ্ছের শেষ বর্ণটি যে স্বরে গিয়ে থামে সেটি দীর্ঘ হয়। এই স্বরের দীর্ঘতা কতটুকু হবে বা না হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে গায়কের ওপরে।
৩. আরম্ভেই ভাটিয়ালি প্রধানত চড়াসুরের দিকে চলে যায় এবং তারপরেই কখনো ধীর মন্দাক্রান্তা লয়ে অথবা দ্রুত ছন্দে নেমে আসে ও বিশ্রাম লাভ করে। ভাটিয়ালিতে সাত স্বরের প্রয়োগ তো আছেই, অধিকন্তু গানের গতি দুই সপ্তক পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। ভাটিয়ালিতে যন্ত্রানুষঙ্গ বড়ো একটা থাকে না। বৈঠার জাল টানা শব্দ, নদীর ঢেউয়ের শব্দ, ছাদ পেটানোর হাতুড়ির শব্দ অথবা বেহালা, বাঁশি বা সারিন্দাই ব্যবহৃত হয়।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।