প্রশ্ন- ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যে বর্ণাশ্রম ও পুরুষাস্ত্রের উপর একটি প্রবন্ধ লেখো আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ। (Write an essay on Varnashram and Purushatras in Brahmanical tradition in circa 300 BCE to CE 750.)
উত্তর-
- বর্ণাশ্রম:
বৈদিক যুগে সমাজে চতুর্বর্ণ প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এই চারটি বর্ণের অস্তিত্ব ছিল। বৈদিক সমাজে এই ধারা পরবর্তী ভারতীয় সমাজেও ছিল।
মৌর্য যুগে বর্ণাশ্রম:
মৌর্যযুগের ইতিহাস জানতে কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র', গ্রিক দূত মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা' প্রভৃতি সাহিত্যিক উপাদান এবং মৌর্য সম্রাট অশোকের লেখর ওপর নির্ভর করতে হয়। মৌর্য যুগের সমাজ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে শ্রুতি ও ধর্মসূত্রকে অনুসরণ করে চাতুর্বর্ণ ও চতুরাশ্রমকে সমাজের গঠন ও গতিপ্রকৃতির নিয়ামক বলা হয়েছে। এই চারটি বর্ণের স্বধর্ম বা কর্তব্যকর্মেরও বিধানের কথা এখানে বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণের স্বধর্ম হল অধ্যায়ন (বেদপাঠ), অধ্যাপন (বিদ্যাবিতড়ন), যজন (নিজের জন্য যজ্ঞ করা), যাজন (অপরকে যজ্ঞ করানো), দান ও প্রতিগ্রহ (দানগ্রহণ)। ক্ষত্রিয়র স্বধর্ম হল অধ্যয়ন, যজন, দান, শাস্ত্র দ্বারা জীবিকা অর্জন ও প্রাণীদের রক্ষা করা। বৈশ্যের স্বধর্ম হল অধ্যয়ন, যজন, দান, কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য করা। শূদ্রের স্বধর্ম হল ব্রাহ্মণাদি দ্বিজাতিদের সেবা, সামাজিক সম্পদ সৃষ্টির জন্য কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য, কারুকর্ম (শিল্পীর কাজ) ও কুশিলব কর্ম (গীত বাদ্যাদি কর্ম)।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে অনুলোম (উচ্চ বর্ণের পুরুষের সঙ্গে নিম্নবর্ণের নারীর) বিবাহ এবং প্রতিলোম (নিম্নবর্ণের পুরুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণের নারীর) বিবাহের ফলে সংকর বা মিশ্র জাতির সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। সমাজে শূদ্রের স্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কৌটিল্যের দৃষ্টিভঙ্গি তুলনায় উদার। উচ্চতর তিন বর্ণের সঙ্গে শূদ্রের বিবাহ সম্ভব ছিল। শূদ্রের সম্পত্তির অধিকারও স্বীকৃত হয়েছে।
মৌর্যোত্তর যুগের বর্ণাশ্রম:
মৌর্য যুগের পরবর্তী এবং গুপ্তযুগের পূর্ববর্তী সময়ে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব থাকলেও মুনস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, মহাভারতের শান্তি পর্ব বা অনুশাসন পর্ব থেকে জানা যায় এযুগে ব্রাহ্মণ্য সমাজদর্শনে প্রধান দুই ভিত্তি চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা ও চতুরাশ্রম প্রথা প্রচলিত ছিল। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী রাজধর্মের অন্যতম প্রধান দিক হল বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে অটুট রাখা। 'মনুস্মৃতি' ও 'যাজ্ঞবল্ক্য' স্মৃতিতে ব্রাহ্মণকে বর্ণশ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণের কাজ হল অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যাজন, দান গ্রহণ প্রভৃতি। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে মনু সকল রাজস্ব দানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। ক্ষত্রিয়র কাজ ছিল যুদ্ধ করা ও শাসনতান্ত্রিক কাজ করা। মনুর মতে, বেদ অধ্যয়নে শুধু ব্রাহ্মণদেরই একচেটিয়া অধিকার নয়, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদেরও সে অধিকার আছে। 'মনুসংহিতা' ও 'যাজ্ঞবন্ধ্য স্মৃতি'তে বলা হয়েছে শূদ্রের কর্তব্য হল উচ্চতর তিনবর্ণ, বিশেষত ব্রাহ্মণের সেবা করা। তবে শূদ্র মাত্রই অস্পৃশ্য ছিল না। শূদ্র বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বিভিন্ন বৃত্তিধারী মানুষ এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতীয় নরগোষ্ঠী। মনু সংকর বা মিশ্র জাতির উল্লেখ করেছেন।
গুপ্তযুগে বর্ণাশ্রম:
গুপ্তযুগে লেখমালা, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, নারদ স্মৃতি, বৃহস্পতি স্মৃতি, কাত্যায়ন স্মৃতি প্রভৃতি থেকে এযুগে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রাধান্য এবং বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। চিনা পর্যটক ফা-হিয়েন-এর বিবরণ এবং পরবর্তীকালের রচনা হলেও হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ এ বিষয়ে তথ্য জানতে সাহায্য করে। যাজ্ঞবন্ধ্য বলেছেন, ব্রাহ্মণ মূলত অধ্যাপনা, যাজন ও প্রতিগ্রহের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করবে। ব্রাহ্মণ বর্ণ শ্রেষ্ঠ হলেও বেদপাঠ না করলে তিনি পতিত হবেন। তাঁর মতে, ক্ষত্রিয়-এর বৃত্তি হল যুদ্ধ করা ও শাসনতান্ত্রিক কাজ করা এবং বৈশ্যের কাজ হল কৃষি, পশুপালন, সুদের কারবার ও ব্যাবসা করা। শূদ্র উচ্চতর তিন বর্ণের সেবা করলেও প্রয়োজনে ব্যবসা ও কারিগরি শিল্প করার অধিকার পেয়েছিল। বরাহমিহির তাঁর বৃহৎ সংহিতায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের জন্য নগরীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বাসস্থানের পরিকল্পনা করেছেন। তাঁর এই পরিকল্পনার সঙ্গে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত 'দুর্গনিবেশ'-এর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। 'দ্বিজ' শব্দটি তখন সাধারণভাবে ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে প্রয়োগ করা হয়েছে। কাত্যায়ন স্মৃতিতে বর্ণভিত্তিক শাস্তির ব্যবস্থার কথা বলা আছে। স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে একদিকে ব্রাহ্মণদের পবিত্রতা অন্যদিকে বর্ণবহির্ভূত ব্যক্তিদের অপবিত্রতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ফা-হিয়েনের বর্ণনায় স্পর্শজনিত অপবিত্রতার কথা জানা যায়।
গুপ্তোত্তর যুগের বর্ণাশ্রম:
গুপ্তোত্তর যুগে ভারতে চার বর্ণের দৃষ্টান্ত লক্ষ করেছেন চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ। ব্রাহ্মণরা ছিলেন বর্ণশ্রেষ্ঠ সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাঁরা ছিলেন নীতিবান, স্পষ্টবাদী, শিক্ষিত, মিতব্যয়ী ও শাস্ত্রজ্ঞ। তিনি তাঁদের পৌরহিত্য বৃত্তির কথা বলেছেন। হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক 'বাঁশখেরা' ও 'মধুবন' লেখতে গুণবান ব্রাহ্মণদের অনুকূলে ভূমিদানের কথা উল্লেখ আছে। ক্ষত্রিয়দের সম্পর্কে হিউয়ের সাঙ বলেছেন পরোপকার ও ক্ষমাই ছিল তাদের জীবনের আদর্শ। বৈশ্যদের প্রধান বৃত্তি ছিল ব্যাবসাবাণিজ্য করা। এসময় বহুসংখ্যক শূদ্র কৃষিকার্যে যুক্ত ছিলেন।
পুরুষশাস্ত্রেরবর্ণাশ্রমের পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা ও সবর্ণ বিবাহের উল্লেখ থাকলেও সে যুগে অসবর্ণ বিবাহ প্রচলিত ছিল। হর্ষচরিতের রচয়িতা এবং হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের পিতা এক শূদ্র রমণীর পাণিগ্রহণ করে। হর্ষবর্ধন বর্ণে বৈশ্য হলেও তাঁর কন্যার সঙ্গে বলভির ক্ষত্রিয় রাজার বিবাহ দেন। গুপ্তোত্তর যুগের দক্ষিণ ভারতে চালুক্য বংশ ও পল্লব বংশের শাসনকালে সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি থাকলেও বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার কঠোরতা ছিল না।
- পুরুষাস্ত্র:
ধর্ম হল অনুভবের বিষয়। কোনো ব্যক্তির সে অনুভব অন্তরে জাগ্রত না হলে তার পক্ষে ধর্মের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। মানবজীবনের পরিপূর্ণতার জন্য যে আদর্শ জীবনযাপন পদ্ধতি পালন করা উচিত তার সন্ধান দেয় ধর্ম। পরিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য মানুষের যে লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়া উচিত, তাই 'পুরুষাস্ত্র' নামে পরিচিত । পুরুষাস্ত্রে মূলত চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ । অর্থ এবং কাম হল মানুষের আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। ধর্মের ধারণা জন্ম, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের বা জন্মান্তরবাদের ধারণার সঙ্গে যুক্ত। ধর্ম বলতে কর্তব্যবোধও বোঝায়। আর মানুষের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল মোক্ষ লাভ করা অর্থাৎ সমস্ত কামনা, বাসনা, তৃষ্ণা ও আসক্তির ঊর্ধ্বে ওঠা, যার মাধ্যমে জীবাত্মার মুক্তিলাভ সম্ভব।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।