প্রশ্নঃ পাল, প্রতিহার
এবং রাষ্ট্রকূটদের মধ্যে ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বের বর্ণনা দাও। প্রশ্ন মানঃ১২
সম্রাট হর্ষবর্ধনের আমল থেকে
পাটলিপুত্রের পরিবর্তে কনৌজ ভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। অষ্টম শতাব্দীর
শেষ দিক থেকে কনৌজ-এর ওপর আধিপত্য এবং উত্তর ভারতে আধিপত্য প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।
নবম শতাব্দী থেকে কনৌজের রাজনৈতিক গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় এবং উত্তর ভারতে আধিপত্য
প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে স্বভাবতই রাজারা কনৌজের ওপর আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী হয়ে উঠে।
এছাড়া গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলের উর্বর ভূমিসম্পদের জন্যও কনৌজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
এই প্রেক্ষাপটে অষ্টম নবম শতাব্দীতে কনৌজ দখলের লক্ষ্যে ভারতবর্ষে এক ত্রিশক্তি সংঘর্ষ
শুরু হয়। এতে অংশগ্রহণ করে পূর্ব পালবংশ, পশ্চিম ভারতের গুর্জর প্রতিহার বংশ এবং দক্ষিণ
ভারতের রাষ্ট্রকূটবংশ। মোটামুটিভাবে 750 খ্রিস্টাব্দ থেকে 950 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
প্রায় 200 বছর ধরে এই ত্রিশক্তি সংঘর্ষ ভারতবর্ষে চলেছে।
ঐতিহাসিক RC Majumdar বাংলার
পালরাজাদের খালিমপুর ও মুঙ্গের তাম্রলিপিতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এবং রাদল মুক্তলিপিতে
উল্লেখিত ঘটনার প্রেক্ষিত এই সংগ্রামকে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে পূর্বভারতে পাল শক্তি
ও পশ্চিম ভারতের গুর্জর প্রতিহার শক্তির বিস্তার নীতির অনুসরণের ফলেই এই দ্বন্দ্বের
উৎপত্তি হয়েছিল। বাস্তবিকই পাল রাজা ধর্মপাল নিজক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর পশ্চিম
কনৌজের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন। আবার এই সময়ে প্রতিহার রাজ বৎসরাজ গুর্জরদের বিভিন্ন
শাখার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে পূর্বদিকে রাজ্যবিস্তারে সচেষ্ট হন। উভয়েই জানতেন
যে উত্তরভারতে আধিপত্য বিস্তারের প্রতীক হল কনৌজ। ফলে ধর্মপালের পশ্চিমমুখী বিস্তার
নীতির সঙ্গে বৎসরাজের পূর্বমুখী বিস্তার নীতির সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য।
এই দুই রাজার সৈন্যবাহিনীর
মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ ঘটে গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলে। RC Majumdar-সহ প্রায় সব ঐতিহাসিকই
মনে করেন যে এই যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হয়েছিলেন কিন্তু জয়লাভ করেও প্রতিহার-রাজ বৎসরাজ
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। এর কারণ পালদের সঙ্গে প্রতিহারদের
দ্বন্দ্বে প্রতিহারদের প্রাথমিক বিজয় তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতির আরেক শক্তি রাষ্ট্রকুটদের
ঈর্ষান্বিত করে তোলে। এ ছাড়া আগ্রা ও মালবে নিজেদের অধিপত্য বিস্তারেও রাষ্ট্রকূটরা
সচেষ্ট ছিল। কিন্তু এই অঞ্চল প্রতিহারদের অধীনে চলে যাওয়ায় রাষ্ট্রকুটরা প্রতিহারকে
দর্পচূর্ণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। অচিরেই রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুব বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম
করে বৎসরাজের বাহিনীকে পরাজিত করেন। বৎসরাজ প্রাণে বাঁচার জন্য রাজপুতানার মরুভূমিতে
পালিয়ে যায়। তারপর তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা জানা যায়নি। ভারত ইতিহাস-এ প্রশ্নের
উত্তর আজও অজানা। তবে একথা ঠিক যে ধ্রুবর নেতৃত্বে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে রাষ্ট্রকূটদের
স্বক্রীয় অংশগ্রহণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলল এবং ত্রিশক্তি সংগ্রাম তার পূর্ণ
চেহারা নিয়ে ভারত ইতিহাসে আবির্ভূত হল। ধ্রুবর হাতে বৎসরাজের পরাজয় পরোক্ষভাবে ধর্মপালের
রাজনৈতিক সুবিধা করেছিল।
নিজরাজ্যে গোলযোগের সূত্রে
ধ্রুব ফিরে যাওয়া মাত্র ধর্মপাল কনৌজে প্রবেশ করে সেখানকার রাজা ইন্দ্রায়াকে পরাজিত
করেন। এর পর তিনি নিজ তাবেদার চক্রায়ুধকে কনৌজের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। চক্রায়ুধকে
কনৌজে প্রতিষ্ঠিত করার সময় পার্শ্ববর্তী ছোটো রাজ্যের রাজাদের উপস্থিতি ছিল তৎকালীন
পরিস্থিতি উত্তর ভারতে ধর্মপালের অপ্রতিহত ক্ষমতার পরিচায়ক। খালিমপুর তাম্রশাসনে এই
বিষয়টির বিস্তৃত উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু ধর্মপালের এই প্রতিপত্তি
ছিল স্বল্পস্থায়ী। কারণ বৎসরাজের পরবর্তী প্রতিহার রাজ দ্বিতীয় নাগভট্টের সাহায্যে
ইন্দ্রায়ুধ কনৌজের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। মুঙ্গের - এর কাছে এক যুদ্ধে ধর্মপাল
ও চক্রায়ুধ পরাজিত হন দ্বিতীয় নাগভট্ট এবং ইন্দ্রায়ুধের কাছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে
এই পর্যায়ে একটি শক্তি হিসেবে কনৌজের অংশগ্রহণকে বিচার করে কোনো-কোনো ঐতিহাসিক এই
সময় থেকে এই দলকে চতুশক্তি সংগ্রাম বলেও অভিহিত করেছেন। যাই হোক, এই যুদ্ধে জয়লাভ
করে দ্বিতীয় নাগভট্ট মালবসহ উত্তর ভারতে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন।
দ্বিতীয় নাগভট্টের এই সাম্রাজ্যবাদী
সম্প্রসারণ অবশ্য রাষ্ট্রকূটদের দৃষ্টি এড়ায়নি। ঐতিহাসিক R C Majumdar অবশ্য মনে
করেন যে ধর্মপাল স্বয়ং এ অবস্থায় রাষ্ট্রকূটদের সাহায্য চেয়েছিলেন। সম্ভবত ধর্মপালের
অনুরোধেই ধ্রুবর পরবর্তী রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় গোবিন্দ প্রতিহাররাজ দ্বিতীয় নাগভট্টের
বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। তৃতীয় গোবিন্দের সামরিক শক্তির সামনে দ্বিতীয় নাগভট্ট তেমন
কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পেরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। তৃতীয় গোবিন্দের
এই বিজয়ের ফলে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল তাঁর শাসনাধীন আসে। এই অবসরে
ধর্মপাল ও তাঁর স্থাবক চক্রায়ুধ তৃতীয় গোবিন্দের প্রাধান্য স্বীকার করে নেন। কনৌজসহ
উত্তর ভারতে প্রতিহারদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা একপ্রকার বিফলতায় পর্যবসিত
হয়।
রাষ্ট্রকূটরাও অবশ্য এই
আধিপত্য বেশিদিন বজায় রাখতে পারেননি। এর কারণ ছিল তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। তৃতীয় গোবিন্দের
মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আমোঘবর্ষের সিংহাসন আহরণ নিয়ে রাষ্ট্রকূট রাজ্যে প্রবল গোলযোগ
সৃষ্টি হয়। ফলে রাষ্ট্রকুটরা নিজরাজ্যেই বঞ্চিত হয়ে পড়েন। এ অবস্থার ধর্মপাল এবং
প্রতিহার রাজ দ্বিতীয় নাগভট্ট আবার নিজেদের আধিপত্য এবং প্রতিহার রাজ দ্বিতীয় নাগভট্ট
ধর্মপালকে পরাজিত করেন। কিন্তু প্রতিহারদের দুর্ভাগ্য যে দ্বিতীয় নাগভট্টের উত্তরাধিকারী
রামভদ্র ছিলেন দুর্বল ও অযোগ্য। পক্ষান্তরে ধর্মপালের উত্তরাধিকারী দেবপাল ছিলেন সুদক্ষ।
ফলে এর পরবর্তী পর্যায়ে পাল-প্রতিহার দ্বন্দ্বে রামভদ্র দেবপালের নিকট শোচনীয়ভাবে
পরাজিত হন। পরবর্তী প্রতিহাররাজ ভোজ কিছুটা চেষ্টা করলেও তিনিও শোচনীয়ভাবে দেবপালের
কাছে পরাজিত হন। এরপর দেবপাল উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জয় করে কনৌজের ওপরও আধিপত্য
প্রতিষ্ঠা করেন।
কিন্তু প্রতিহাররাজ ভোজ
হতাশ না হয়ে নিজ ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকেন। দেবপালের মৃত্যুর পর দুর্বল
পালরাজা নারায়ণ পালকে পরাজিত করে তিনি মগধ পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। ফলে
কনৌজ নিশ্চিতভাবেই তার দখলে আসে। ভোজের পুত্র মহেন্দ্রর সময় প্রতিহার রাজ্যের আরও
বিস্তৃতি ঘটে। তৎকালীন রাষ্ট্রকুট রাজ তৃতীয় ইন্দ্রও রাষ্ট্রকূটদের লুপ্তগৌরব পুনরুদ্ধারের
চেষ্টা করতে থাকেন। এমনকি তিনি উত্তর ভারতে অভিযান চালিয়ে মহেন্দ্রকে পরাজিত করে কিছুদিনের
জন্য কনৌজ নিজ অধিকারেরও এনেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রকূট রাজ্যে আবার গোলযোগ সৃষ্ট হলে
তাঁকে উত্তর ভারত পরিত্যাগ করতে হয়। অন্যদিকে পাল রাজারাও এ সময় নিজেদের অস্তিত্ব
বজায় রাখতে ব্যস্ত হয়ে পরেন। এই সুযোগে মহেন্দ্রর পরবর্তী প্রতিহাররাজ মহীপাল কনৌজ
পুনরুদ্ধার করেন, তবে তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিহারদেরও পতন শুরু হয় এবং এভাবেই শেষ পর্যন্ত
ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমার উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
6295916282; 7076398606
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।