প্রশ্নঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের
জনক বলা যায় কী না তা যুক্তিসহ আলোচনা কর?
ঊনবিংশ
শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক ধ্রুবতারা। বাংলা গদ্যের বিকাশে
তাঁর অবদান এতটাই বৈপ্লবিক ও সুদূরপ্রসারী যে, তাঁকে সাধারণ বিচারে 'বাংলা গদ্যের জনক'
বলা হয়ে থাকে। তবে সাহিত্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁর আগেও বাংলা গদ্যের
অস্তিত্ব ছিল। তাই তাঁকে আক্ষরিক অর্থে 'জনক' বলা হবে, নাকি 'গদ্যের প্রথম শিল্পী'
বলা হবে—তা নিয়ে সমালোচকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও, গদ্যকে সাহিত্যিক রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব
নিঃসন্দেহে তাঁরই।
বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবের আগে বাংলা গদ্যের নিদর্শন থাকলেও তা ছিল অসংলগ্ন এবং সাহিত্যিক গুণবর্জিত। উইলিয়াম কেরি, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ গদ্য রচনা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের গদ্য ছিল আড়ষ্ট। রামমোহনের গদ্য ছিল যুক্তিনির্ভর এবং বিচার-বিতর্কের বাহন, তাতে হৃদয়ের আবেগ বা সাহিত্যের নমনীয়তা ছিল না।তৎকালীন গদ্যে ছেদ-চিহ্নের ব্যবহার ছিল না, পদবিন্যাস ছিল বিশৃঙ্খল এবং ভাষা ছিল হয় অতিরিক্ত সংস্কৃত-ঘেঁষা নতুবা গ্রাম্য দোষে দুষ্ট।
১৮৪৭
সালে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' প্রকাশের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যে এক নতুন যুগের সূচনা
করেন। তাঁর অবদানগুলিকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়। বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা গদ্যে
ইংরেজি রীতির অনুকরণে কমা (,), সেমিকোলন (;) ইত্যাদি যতিচিহ্নের সার্থক ব্যবহার শুরু
করেন। এর ফলে গদ্যের অর্থ স্পষ্ট হয় এবং পাঠকদের কাছে তা সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে। তিনি বাংলা
বাক্যে কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়ার অবস্থান সুনির্দিষ্ট করেন। এলোমেলো শব্দ সাজানোর পরিবর্তে
তিনি বাক্যের মধ্যে একটি অন্বয় বা শৃঙ্খলা নিয়ে আসেন। তিনি সংস্কৃত শব্দ এবং লৌকিক
বাংলা শব্দের মধ্যে এক অপূর্ব ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের
মতো তিনি দুরূহ শব্দ ব্যবহার করেননি, আবার 'আলালী' ভাষার মতো অতিরিক্ত গ্রাম্যতাও বর্জন
করেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের
গদ্যে এক ধরণের অন্তঃলীন সুর বা ছন্দ আছে। শব্দ ব্যবহারের নিপুণতায় তিনি গদ্যকে কাব্যের
মতো শ্রুতিমধুর করে তুলেছিলেন। একেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "গদ্যের পদবিন্যাস"
বলে অভিহিত করেছেন।
বিদ্যাসাগরকে
'জনক' বলা হবে কি না, এই তর্কে সবচেয়ে জোরালো মত দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বিদ্যাসাগরকে
বাংলা গদ্যের 'জনক' না বলে 'বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী' (The first artist of
Bengali Prose) বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— "বিদ্যাসাগর বাংলা
গদ্যের চিকীর্ষু নহেন, তিনি বাংলা গদ্যের সৃষ্টা। ...তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে যতিচিহ্নের
ব্যবহার করিয়া তাহাকে শাসন ও সংযম দান করিয়াছেন।" রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছেন
যে, বিদ্যাসাগরের আগে গদ্য ছিল কেবল ভাব প্রকাশের মাধ্যম, কিন্তু বিদ্যাসাগর তাকে
'শিল্পে' উন্নীত করেছেন।
বিদ্যাসাগরের
অধিকাংশ গদ্যগ্রন্থ অনুবাদমূলক (যেমন—শকুন্তলা, সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস)। কিন্তু
তাঁর অনুবাদ ছিল ভাবানুবাদ। তিনি মূল কাহিনিকে এমনভাবে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করেছেন
যে, তা মৌলিক সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। বিশেষ করে 'শকুন্তলা' (১৮৫৪) এবং 'সীতার বনবাস'
(১৮৬০) গ্রন্থে তাঁর ভাষার কবিত্বশক্তি ও আবেগ বাংলা গদ্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
আক্ষরিক
অর্থে 'জনক' হলেন তিনি, যিনি জন্ম দেন। বাংলা গদ্যের জন্ম বিদ্যাসাগরের হাতে হয়নি,
তা হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের হাতে বা পর্তুগিজ মিশনারিদের হাতে। কিন্তু
সেই গদ্য ছিল 'প্রাণহীন দেহ'। বিদ্যাসাগর সেই দেহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি গদ্যকে
হাটে-বাজারে ব্যবহারের ভাষা থেকে ড্রয়িংরুমে ও সাহিত্যের দরবারে স্থান করে দিয়েছেন।
তাই ঐতিহাসিক বিচারে তিনি গদ্যের 'আদি পিতা' না হলেও, গুণগত ও সাহিত্যিক বিচারে তিনি
অবশ্যই 'আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক'।
পরিশেষে
বলা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের নির্মাতা এবং রূপকার। তিনি অগোছালো বাংলা
ভাষাকে নিয়ম-শৃঙ্খলার ফ্রেমে বেঁধে তাকে গতিময়, শ্রুতিমধুর এবং ভাবপ্রকাশের উপযোগী
করে তুলেছিলেন। তাঁর তৈরি করা কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র ও
রবীন্দ্রনাথের গদ্যশৈলী গড়ে উঠেছে। তাই রবীন্দ্রনাথের কথার রেশ ধরে বলা যায়—তিনি কেবল বাংলা গদ্যের
জনক নন, তিনি বাংলা গদ্য-রীতির সার্থক ও প্রথম শিল্পী।
জ্ঞ্যানজ্যোতি
কোচিং সেন্টার
তোমাদের
উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
6295916282; 7076398606
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।

