প্রশ্ন: রোম সাম্রাজ্যের পতনের কারণ আলোচনা করো।
[Discuss The Reason Behind the Decline of the Roman Empire]
*****************************************
উত্তরঃ খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধে গথ, হুন, এলমানি প্রভৃতি বর্বর জাতির আক্রমণে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের অবক্ষয় নিশ্চিত হয়ে যায়। অবশেষে 476 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বৈদেশিক আক্রমণে বিদ্ধস্ত পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যে জার্মান উপজাতি নায়ক থিয়োডোরিক শেষ রোমান সম্রাট রোমিউলাস অস্টাস্টুলাস সিংহাসনচ্যুত করলে আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। উল্লেখ্য, সম্রাট কনস্ট্যানটাইন (মৃত্যু 337 খ্রিঃ) প্রশাসনিক সুবিধার জন্য রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী বাইজানটিয়ামে স্থানান্তরিত করেছিলেন। সুতরাং, তিনি বাইজানটিয়ামকেন্দ্রিক যে অখণ্ড রোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য গড়েছিলেন তা 476 খ্রিস্টাব্দের পর অবান্তর হয়ে যায়। কারণ পরবর্তী সম্রাট জেনো কাগজে-কলমে সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের অধীশ্বর থাকলেও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অঞ্চল বর্বর জাতির দখলে চলে যায়। পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের পতনের কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায় কেবলমাত্র বৈদেশিক আক্রমণের জন্য এর পতন ঘটেছিল এমনটা বলা যায় না, তার পতনের নানা কারণ ছিল।
রোমের শেষ পর্বের সম্রাটদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিলেন অপদার্থ এবং অত্যাচারী। এজন্য রোমান সৈন্যদলের মধ্যে ছিল চরম উৎশৃঙ্খলতা। প্রাদেশিক শাসকরা এসময় সুযোগর সদ্ব্যবহার করে প্রায় স্বাধীন হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ একদা শান্তির প্রতীক 'রোম' বিভীষিকার চরম নিদর্শনে পরিণত হয়। রোমের সেনাবাহিনীতে নানা জাতি ও নানা অঞ্চলের সৈন্য থাকত। যারা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য দেখানোর পরিবর্তে কিংবা সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সিংহাসনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেশি ব্যস্ত থাকত, যা রোমান সাম্রাজ্যকে প্রায় শক্তিহীন করে তোলে।
কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা এবং চরম ভোগবিলাসিতা রোমের জনসাধারণকে নীতিজ্ঞানহীন করে তোলে। এসময় ক্রীতদাসদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা ছড়ায়। প্রজাদের থেকে মাত্রাতিরিক্ত কর আদায় করা হতে থাকে। পরিণতিস্বরূপ সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হয় বিদ্রোহ।
রোমের পতনের অপর কারণ হিসেবে এই সাম্রাজ্যের বিশালতাকেও দায়ী করা হয়। তিন মহাদেশব্যাপী বিস্তৃত রোমান সাম্রাজ্যে কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে সম্ভব ছিল না দূরবর্তী অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। প্রশাসনিক কাজকর্মের সুবিধার জন্য রোমানরা যথেষ্ট রাস্তাঘাট নির্মাণ করলেও বর্তমানের ন্যায় যানবাহনের সুবিধা না থাকায় কোথাও বিদ্রোহ শুরু হলে তা দ্রুত দমন করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
শেষ পর্বে রোম একাধিক যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়েছিল, যা তার লোকক্ষয় এবং অর্থনৈতিক অবক্ষয় ঘটায়। এর ফলে রোম সাম্রাজ্যের ভিত্তি শিথিল হয়। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ভিসিগথ, এলমানি, জার্মান প্রভৃতি উপজাতি গোষ্ঠী পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে।
পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বর্বরদের হাতে চলে যাবার পরেও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তথা কনস্ট্যান্টিনোপলকেন্দ্রিক বাইজানটাইন সাম্রাজ্য নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় হাজার বছর টিকে ছিল। এসময় সে সযত্নে ধরে রাখে ধ্রুপদি সাহিত্য ও ভাবনাচিন্তা-যা থেকে গড়ে উঠে পঞ্চদশ শতকের রেনেশাঁ বা নবজাগৃতি।
পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের এই দীর্ঘায়ু সম্ভব হয়েছিল সম্রাটের সীমাহীন ক্ষমতা, রোমান আইন, শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও নৌবহরের উপস্থিতির কারণে। সম্রাট জাস্টিনিয়ানের উদ্যোগে 529 খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত পণ্ডিতদের নিয়ে দু-হাজার আইনের এক সংকলন তৈরি করা হয় যা 'ডাইজেস্ট' নামে খ্যাত। পরে আইনি পুস্তিকা 'নভেলি' প্রকাশ করা হয়। জনসাধারণ এই আইনকে মেনেও চলত। বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের নৌ ও সেনাবাহিনী ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। তার সর্বোচ্চ আয়তনের দিনে সৈন্যসংখ্যা ছিল 1,20,000-এর মতো। এর সঙ্গে ভাড়াটে সৈন্যদেরও নিযুক্ত করা হত বেশ বড়ো সংখ্যায়। ভাড়াটে সেনাদের রাখার জন্য বিপুল অর্থের দরকার হত। সাম্রাজ্যের অর্থবল কমে এলে তাদের আর বেতন দেওয়া যায়নি। একারণে ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে তারা সরে যায় এবং কনস্ট্যান্টিনোপল অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
ত্রয়োদশ শতকে এশিয়া মাইনরে মোঙ্গল আক্রমণের সময় কিছু তুর্কি গোষ্ঠীর আগমন ঘটেছিল। এর মধ্যে ওসমানের নেতৃত্বাধীন ওসমানলী বা অটোমান গোষ্ঠী রীতিমতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তারাই বাইজানটাইন বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। 1448 খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জনের মৃত্যুর পর একাদশ কনস্ট্যান্টাইন সম্রাট হন। কিন্তু তিনি অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মামুদের মত দক্ষ ছিলেন না। তা ছাড়া শত্রুপক্ষের কামান-বন্দুকে সুসজ্জিত বিশাল গোলন্দাজ বাহিনীর কাছে ভগ্নদশাগ্রস্ত কনস্ট্যান্টিনোপলের দুর্বল সেনাবাহিনীর পক্ষে পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না। 1453 খ্রিস্টাব্দের 27 মে একারণে অটোমান তুর্কিরা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী শহরের বিরাট প্রাচীর অতিক্রম করে ব্যাপক লুঠপাট চালাতে সক্ষম হয় এবং হত্যা করে সম্রাটকে। আনুষ্ঠানিকভাবে পতন ঘটে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যেরও। এ প্রসঙ্গে র্যান্সিম্যান লিখেছেন-"The blend of Imperial Rome and Christian Greece became a thing of the irreparable past".
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।