বৈয়াকরণ
-সতীনাথ ভাদুড়ী
গল্পটি
শুরু থেকে লেখক মূল বিষয়টিকে কেন্দ্রীভূত করেছেন সংস্কৃত পণ্ডিত তুরস্তলালজী নামক
চরিত্রটির ভাবনার মধ্যে দিয়ে। নারীর চোখে ধরা পড়া পুরুষের আসল রূপ এবং পুরুষের নারী
সম্পর্কে ধারণ এই দুই বিষয়ের সত্যতাকে যাচাই করতে তুরন্তলালজী নানা ভাবে নিজেকে, নিজের
আচরণকে এবং তার পরিচিত আত্মীয় পুরুষদেরকে নিয়ে একটি বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
তুরগুলালজীর ভাবনার জগতে এই প্রশ্নের উদয় হয় যেভাবে তাঁর গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক
স্পষ্ট করেছেন “আজ মাস দুয়েক থেকে পণ্ডিতজীর মনটা ভালো যাচ্ছে না। একটি মুমূর্ষু মহিলার
মুখ থেকে নির্গত একটি বাক্য তার কর্ণগোচর হবার পর থেকে অষ্টপ্রহর তাকে পীড়া দিচ্ছে।
“তুরগুলালজী
শালাজ স্টোভের আগুনে পুড়ে মৃত্যুর সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করছে তখন একদিন সে তার ননদের
অর্থাৎ পণ্ডিতজীর স্ত্রীর একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল...ওরা কি ওই চায়!” গভীর দীর্ঘশ্বাসের
সঙ্গে একজন মৃত্যুপথযাত্রীর এই হৃদয় নিংড়ানো কথাটি পণ্ডিতজীকে তার পৌরুষত্বের অহংকারে
তীক্ষ্ণ আঘাত হেনেছিল। তারপর থেকেই প্রতিনিয়ত পণ্ডিতজী নিজের ব্যাকরণের জ্ঞান, জগত
জীবনের নানা বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে 'ওরা' শব্দটির প্রকৃত অর্থ খুঁজতে শুরু
করেন। পণ্ডিতজীর এই অন্বেষণ তার মনের এই প্রশ্নকে সতীনাথ ভাদুড়ী গল্পটির মধ্যে যেভাবে
যুক্ত করেছেন তার উল্লেখেই আমাদের কাছে পণ্ডিতজী চরিত্রটির অনেক অজানা দিক স্পষ্ট হয়ে
যায় আর সেই মুমূর্ষুর উক্তির যে শব্দটি দু'মাস থেকে তার মনে কিরকির করে বিধছে, সেটা
একটা সর্বনাম; তার উপর বহুবচন। দুটোর মধ্যে কোনো মিল নেই, কোনো সম্পর্ক নেই। শব্দটা
হচ্ছে 'ওরা'। বাক্যটি হচ্ছে “ওরা কি ওই চায়।' এই 'ওরা' শব্দটিকে নিয়েই যত গোলমাল।"
শালাজের
কথার সূত্র তুরগুলালজী যেভাবে নিজেকে বিশ্লেষণ করেছে তাতে আমাদের আশ্চর্য করে। লেখক
এই গল্পে পণ্ডিতজী চরিত্রকে দুটো সত্তায় বিভক্ত করেছেন এবং এই দুটি সত্তার পৃথক পৃথক
অনুধাবন উপলব্ধিকে প্রকাশ করেছেন ভাষার ঐশ্বর্যে। পণ্ডিতজী চরিত্রের একটি সত্তা যে
সত্তাটি। তার আরেকটি সত্তাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। পণ্ডিতঙ্গী মেয়েদের
স্কুলে পড়াতে গিয়ে সংকোচ ও জড়তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ছেলেদের স্কুলে পড়াতে গিয়ে
তিনি এরকম হননি কিন্তু মেয়েদের স্কুলে পড়াতে গিয়ে তিনি জড়তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
পণ্ডিতজী নিজেকেই প্রশ্ন করেছেন পরস্ত্রীর ছোঁয়া থেকে বাঁচবার জন্য তার এত শুচিবাই
কেন, কেন তিনি স্ত্রীলোকদের সামনে সহজ ব্যবহার করতে পারেন না। এই দুটি সংলাপ থেকে পণ্ডিতজীর
চরিত্রের দ্বৈত সত্তাকে চিহ্নিত করা যায়। যে সত্তার একদিকে তিনি নিজেকে সৎ নিষ্কলঙ্ক
সংযমী বলে মনে করেন। নিজের সম্পর্কে যেখানে তার বদ্ধমূল ধারণা—তিনি
ব্যাকরণের বিধানগুলোর মতই নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে সংযমের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলেছেন। তার আচরণ,
তার প্রতিটি পদক্ষেপে কোনো চ্যুতি ঘটেনি। এই পণ্ডিতজী আবার মনির সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের
পর এবং নিজের শ্যালক ও নিজের সহকর্মী মৌলবী সাহেবের আচরণের প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তে
উপনীত হন যে সবাই সমান।
“ওরা
কি ওই চায়।' এই ছোট বাক্যটি পণ্ডিতদের শালাজের মনের গভীর কষ্ট ক্ষোভ এবং পুরুষ জাতি
সম্পর্কে তার বাস্তব উপলব্ধিকে লেখক যেভাবে প্রকাশ করেছেন তাতে গল্পটি অন্য মাত্রা
পেয়েছে। গল্পে তুরন্তলালজী শালাজের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ শ্যালক যখন আবার মাত্র দুমাস
যেতে না যেতেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় তখন তুরগুলালজী তার ব্যক্তিগত
উপলব্ধি দিয়ে বুঝতে পারে মৃত্যুশয্যায় তার শালাজের বলে যাওয়া কথাভরা কি চায়!-র
যথার্থতা।
মৌলবী
সাহেব বৃদ্ধ বয়সে আরোও একবার বিবাহ করার জন্য নিজের পক্ককেশ এবং শ্মশ্রুমণ্ডলীকে রঞ্জিত
করেছেন এবং তার জন্য তিনি লোকনিন্দাও সহ্য করতে রাজি। তার বাসনা সপ্ত নয়। কিন্তু নিষ্ঠাবান
ব্রাহ্মণ সংস্কৃত পণ্ডিত তার জীবনাচরণে যে নিষ্ঠা এবং সংযমের পরিচয়। দিয়েছেন তা কি
প্রকারান্তরে আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? মালবিকা ঘোষ বিদ্যাললেরর সুন্দরী ছাত্রী, তার সঙ্গে
তিনি সহজ ভাবে ব্যবহার করতে পারেন না, কিন্তু রূপহীনা ছাত্রী লিলিকে বিনা দোষে তিরস্কৃত
করেন। অগ্নিদগ্ধ যুবতী ছোট শ্যালকের স্ত্রী মৃত্যুকালীন শেষ কথায় বহুবচনে ব্যবহৃত
হওয়ায় নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মণ বিশেষ বিচলিত হয়ে পড়েন। কেননা তার কথায় সমগ্র পুরুষ
জাতিকে ইন্দ্ৰিয়াসক্ত রূপে দেখতে হয়। অথচ পণ্ডিত ব্রাহ্মণ নিজেকে সাধারণের ঊর্ধ্বে
বলে মনে করেন। ইন্দ্রিয়াশক্তির উপর আরোপিত নিষ্ঠাচার জীবনাচরণের পথে মসৃণ করে না বরং
আত্মবিশ্লেষণে জীবনকে আরও বিষময় করে তোলে।
গল্পের
শেষে দেখা যায় ছোট ছেলের বিয়ের খবর পণ্ডিতজী তার স্ত্রীকে দিতে চাননি। ছোট শালার
বিয়েটা সে মেনে দিতে পারছে না। তাই ছোট শালার বিয়ের খবর যে চিঠিতে এসেছে সেটা পণ্ডিতজী
তার স্ত্রীর কাছে গোপন করে দেখতে চেয়েছে তার স্ত্রী ধরে ফেলে কিনা। পণ্ডিতজী মনে করে
মেয়েমানুষদের চোখে ধুলো দেওয়া অত সহজ নয়। তবু সে একবার জেনেশুনেই মিথ্যাচার করে
দেখবে। এই মিথ্যাচার পণ্ডিতজী মনে করেছেন প্রথম। কিন্তু হয়ত তার মনের অজান্তেই মিথ্যাচার
করেছেন আর বকধার্মিক নামটিও সেই কারণে সার্থক হয়েছে।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই
আমাদের প্রতিশ্রুতি
6295916282;
7076398606
মাসে ২০টাকা বেতনে পড়াশুনা করতে অবশ্যই যোগাযোগ করো আমাদের সঙ্গে।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।