“স্ত্রীর পত্র”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শ্রীচরণকমলেষু
আজ পনেরো বছর আমাদের বিবাহ
হয়েছে,আজ পর্যন্ত তোমাকে চিঠি লিখি নি। চিরদিন কাছেই পড়ে আছি -- মুখের কথা অনেক শুনেছ,
আমিও শুনেছি;চিঠি লেখবার মতো ফাঁকটুকু পাওয়া যায় নি।
আজ আমি এসেছি তীর্থ করতে শ্রীক্ষেত্রে,
তুমি আছ তোমার আপিসের কাজে। শামুকের সঙ্গে খোলসের যে সম্বন্ধ কলকাতার সঙ্গে তোমার তাই;
সে তোমার দেহ মনের সঙ্গে এঁটে গিয়েছে; তাই তুমি আপিসে ছুটির দরখাস্ত করলে না। বিধাতার
তাই অভিপ্রায় ছিল; তিনি আমার ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর করেছেন।
আমি তোমাদের মেজোবউ। আজ পনেরো
বছরের পরে এই সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে জানতে পেরেছি, আমার জগৎ এবং জগদীশ্বরের সঙ্গে আমার
অন্য সম্বন্ধও আছে। তাই আজ সাহস করে এই চিঠিখানি লিখছি, এ তোমাদের মেজোবউয়ের চিঠি নয়।
তোমাদের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ
কপালে যিনি লিখেছিলেন তিনি ছাড়া যখন সেই সম্ভাবনার কথা আর কেউ জানত না,সেই শিশুবয়সে
আমি আর আমার ভাই একসঙ্গেই সান্নিপাতিক জ্বরে পড়ি। আমার ভাইটি মারা গেল, আমি বেঁচে উঠলুম।
পাড়ার সব মেয়েরাই বলতে লাগল ,'মৃণাল মেয়ে কি না, তাই ও বাঁচল,বেটাছেলে হলে কি আর রক্ষা
পেত?' চুরিবিদ্যাতে যম পাকা, দামি জিনিসের পরেই তার লোভ।
আমার মরণ নেই। সেই কথাটাই
ভালো করে বুঝিয়ে বলবার জন্যে এই চিঠিখানি লিখতে বসেছি।
যেদিন তোমাদের দূরসম্পর্কের
মামা তোমার বন্ধু নীরদকে নিয়ে কনে দেখতে এলেন,তখন আমার বয়স বারো। দুর্গম পাড়াগাঁয়ে
আমাদের বাড়ি, সেখানে দিনের বেলা শেয়াল ডাকে। স্টেশান থেকে সাত ক্রোশ স্যক্রা গাড়িতে
এসে বাকি তিন মাইল কাঁচা রাস্তায় পালকি করে তবে আমাদের গাঁয়ে পৌঁছনো যায়। সেদিন তোমাদের
কী হয়রানি। তার উপরে আমাদের বাঙাল দেশের রান্না -- সেই রান্নার প্রহসন আজও মামা ভোলেন
নি।
তোমাদের বড়োবউয়ের রূপের অভাব
মেজবউকে দিয়ে পূরণ করবার জন্যে তোমার মায়ের একান্ত জিদ ছিল। নইলে এত কষ্ট করে আমাদের
সে গাঁয়ে তোমরা যাবে কেন? বাংলাদেশে পিলে যকৃত অম্লশূল এবং কনের জন্যে তো কাউকে খোঁজ
করতে হয় না -- তারা আপনি এসে চেপে ধরে, কিছুতে ছাড়তে চায় না।
বাবার বুক দুর্দুর্ করতে
লাগল,মা দুর্গানাম জপ করতে লাগলেন। শহরের দেবতাকে পাড়াগাঁয়ের পূজারি কী দিয়ে সন্তুষ্ট
করবে। মেয়ের রূপের উপর ভরসা, কিন্তু, সেই রূপের গুমর তো মেয়ের মধ্যে নেই, যে ব্যক্তি
দেখতে এসেছে সে তাকে যে-দামই দেবে সেই তার দাম। তাই তো হাজার রূপে গুণেও মেয়েমানুষের
সংকোচ কিছুতে ঘোচে না।
সমস্ত বাড়ির, এমন-কি, সমস্ত
পাড়ার এই আতঙ্ক আমার বুকের মধ্যে পাথরের মতো চেপে বসল। সেদিনকার আকাশের যত আলো এবং
জগতের সকল শক্তি যেন বারো বছরের একটি পাড়াগেঁয়ে মেয়েকে দুইজন পরীক্ষকের দুইজোড়া চোখের
সামনে শক্ত করে তুলে ধরবার জন্যে পেয়াদাগিরি করছিল -- আমার কোথাও লুকোবার জায়গা ছিল
না।
সমস্ত আকাশকে কাঁদিয়ে দিয়ে
বাঁশি বাজাতে লাগল -- তোমাদের বাড়িতে এসে উঠলুম। আমার খুঁতগুলি সবিস্তারে খতিয়ে দেখেও
গিন্নির দল সকলে স্বীকার করলেন, মোটের উপর আমি সুন্দরী বটে। সে কথা শুনে আমার বড়ো জায়ের
মুখ গম্ভীর হয়ে গেল । কিন্তু,আমার রূপের দরকার কী ছিল তাই ভাবি। রূপ-জিনিসটাকে যদি
কোনো সেকেলে পন্ডিত গঙ্গামৃত্তিকা দিয়ে গড়তেন, তা হলে ওর আদর থাকত; কিন্তু,ওটা যে কেবল
বিধাতা নিজের আনন্দে গড়েছেন, তাই তোমাদের ধর্মের সংসারে ওর দাম নেই।
আমার যে রূপ আছে, সে কথা ভুলতে
তোমার বেশিদিন লাগে নি। কিন্তু, আমার যে বুদ্ধি আছে, সেটা তোমাদের পদে পদে স্মরণ করতে
হয়েছে। ঐ বুদ্ধিটা আমার এতই স্বাভাবিক যে তোমাদের ঘরকন্নার মধ্যে এতকাল কাটিয়েও আজও
সে টিঁকে আছে। মামার এই বুদ্ধিটার জন্যে বিষম উদ্বিগ্ন ছিলেন, মেয়েমানুষের পক্ষে এ
এক বালাই । যাকে বাধা মেনে চলতে হবে, সে যদি বুদ্ধিকে মেনে চলতে চায় তবে ঠোকর খেয়ে
তার কপাল ভাঙবেই। কিন্তু কী করব বলো। তোমাদের ঘরের বউয়ের যতটা বুদ্ধির দরকার বিধাতা
অসতর্ক হয়ে আমাকে তার চেয়ে অনেকটা বেশি দিয়ে ফেলেছেন, সে আমি এখন ফিরিয়ে দিই কাকে।
তোমরা আমাকে মেয়ে-জ্যাঠা বলে দুবেলা গাল দিয়েছে। কটু কথাই হচ্ছে অক্ষমের সান্ত্বনা;
অতএব সে আমি ক্ষমা করলুম।
আমার একটা জিনিস তোমাদের ঘরকন্নার
বাইরে ছিল, সেটা কেউ তোমরা জান নি। আমি লুকিয়ে কবিতা লিখতুম। সে ছাইপাঁশ যাই হোক-না,
সেখানে তোমাদের অন্দরমহলের পাঁচিল ওঠে নি। সেইখানে আমার মুক্তি; সেইখানে আমি আমি। আমার
মধ্যে যা-কিছু তোমাদের মেজোবউকে ছাড়িয়ে রয়েছে, সে তোমরা পছন্দ কর নি,চিনতেও পার নি;
আমি যে কবি, সে এই পনেরো বছরেও তোমাদের কাছে ধরা পড়ে নি।
তোমাদের ঘরের প্রথম স্মৃতির
মধ্যে সব চেয়ে যেটা আমার মনে জাগছে সে তোমাদের গোয়ালঘর। অন্দরমহলের সিঁড়িতে ওঠবার ঠিক
পাশের ঘরেই তোমাদের গোরু থাকে, সামনের উঠোনটুকু ছাড়া তাদের আর নড়বার জায়গা নেই। সেই
উঠোনের কোণে তাদের জাব্না দেবার কাঠের গামলা। সকালে বেহারার নানা কাজ; উপবাসী গোরুগুলো
ততক্ষণ সেই গামলার ধারগুলো চেটে চেটে চিবিয়ে চিবিয়ে খাব্লা করে দিত। আমার প্রাণ কাঁদত।
আমি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে -- তোমাদের বাড়িতে যেদিন নতুন এলুম সেদিন সেই দুটি গোরু এবং তিনটি
বাছুরই সমস্ত শহরের মধ্যে আমার চিরপরিচিত আত্মীয়ের মতো আমার চোখে ঠেকল। যতদিন নূতন
বউ ছিলুম নিজে না খেয়ে লুকিয়ে ওদের খাওয়াতুম; যখন বড়ো হলুম তখন গোরুর প্রতি আমার প্রকাশ্য
মমতা লক্ষ করে আমার ঠাট্টার সম্পর্কীয়েরা আমার গোত্র সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগবেন।
আমার মেয়েটি জন্ম নিয়েই মারা
গেল। আমাকেও সে সঙ্গে যাবার সময় ডাক দিয়েছিল। সে যদি বেঁচে থাকত তা হলে সেই আমার জীবনে
যা-কিছু বড়ো, যা-কিছু সত্য সমস্ত এনে দিত; তখন মেজোবউ থেকে একেবারে মা হয়ে বসতুম। মা
যে এক-সংসারের মধ্যে থেকেও বিশ্ব-সংসারের। মা হবার দুঃখটুকু পেলুম কিন্তু মা হবার মুক্তিটুকু
পেলুম না ।
মনে অছে, ইংরেজ ডাক্তার এসে
আমদের অন্দর দেখে আশ্চর্য্য হয়েছিল এবং আঁতুড়ঘর দেখে বিরক্ত হয়ে বকাবকি করেছিল। সদরে
তোমাদের একটু বাগান আছে। ঘরে সাজসজ্জা আসবাবের অভাব নেই, আর,অন্দরটা যেন পশমের কাজের
উলটো পিঠ; সেদিকে কোনো লজ্জা নেই, শ্রী নেই , সজ্জা নেই। সেদিকে আলো মিট্মিট্ করে
জ্বলে; হাওয়া চোরের মতো প্রবেশ করে; উঠোনের আবর্জনা নড়তে চায় না; দেওয়ালের এবং মেজের
সমস্ত কলঙ্ক অক্ষয় হয়ে বিরাজ করে। কিন্তু, ডাক্তার একটা ভুল করেছিল, সে ভেবেছিল, এটা
বুঝি আমাদের অহোরাত্র দুঃখ দেয়। ঠিক উলটো অনাদর জিনিসটা ছাইয়ের মতো,সে ছাই আগুনকে হয়তো
ভিতরে ভিতরে জমিয়ে রাখে কিন্তু বাইরে থেকে তার তাপটাকে বুঝতে দেয় না। আত্মসন্মান যখন
কমে যায় তখন অনাদরকে তো অন্যায্য বলে মনে হয় না। সেইজন্যে তার বেদনা নেই। তাই তো মেয়েমানুষ
দুঃখ বোধ করতেই লজ্জা পায়। আমি তাই বলি, মেয়েমানুষকে দুঃখ পেতেই হবে, এইটে যদি তোমাদের
ব্যবস্থা হয়, তা হলে যতদূর সম্ভব তাকে অনাদরে রেখে দেওয়াই ভালো; আদরে দুঃখে ব্যাথাটা
কেবল বেড়ে ওঠে।
যেমন করেই রাখ, দুঃখ যে আছে,এ
কথা মনে করবার কথাও কোনোদিন মনে আসে নি। আঁতুড়ঘরে মরণ মাথার কাছে এসে দাঁড়াল,মনে ভয়ই
হল না। জীবন আমাদের কীই-বা যে মরণকে ভয় করতে হবে? আদরে যত্নে যাদের প্রাণের বাঁধন শক্ত
করেছে মরতে তাদেরই বাধে। সেদিন যম যদি আমাকে ধরে টান দিত তা হলে আলগা মাটি থেকে যেমন
অতি সহজে ঘাসের চাপড়া উঠে আসে সমস্ত শিকড়সুদ্ধ আমি তেমনি করে উঠে আসতুম। বাঙালির মেয়ে
তো কথায় মরতে যায়। কিন্তু, এমন মরায় বাহাদুরিটা কী। মরতে লজ্জা হয়; আমাদের পক্ষে ওটা
এতই সহজ।
আমার মেয়েটি তো সন্ধ্যাতারার
মতো ক্ষণকালের জন্যে উদয় হয়েই অস্ত গেল। আবার আমার নিত্যকর্ম এবং গোরুবাছুর নিয়ে পড়লুম।
জীবন তেমনি করেই গড়াতে গড়াতে শেষ পর্যন্ত কেটে যেত; আজকে তোমাকে এই চিঠি লেখবার দরকারই
হত না। কিন্তু, বাতাসে সামান্য একটা বীজ উড়িয়ে নিয়ে এসে পাকা দালানের মধ্যে অশথগাছের
অঙ্কুর বের করে; শেষকালে সেইটুকু থেকে ইঁটকাঠের বুকের পাঁজর বিদীর্ণ হয়ে যায়। আমার
সংসারের পাকা বন্দোবস্তের মাঝখানে ছেটো একটুখানি জীবনের কণা কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল;
তার পর থেকে ফাটল শুরু হল।
বিধবা মার মৃত্যুর পরে আমার
বড়ো জায়ের বোন বিন্দু তার খুড়ততো ভাইদের অত্যাচারে আমাদের বাড়িতে তার দিদির কাছে এসে
যেদিন আশ্রয় নিলে, তোমরা সেদিন ভাবলে, এ আবার কোথাকার আপদ। আমার পোড়া স্বভাব , কী করব
বলো -- দেখলুম, তোমরা সকলেই মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠেছ, সেইজন্যেই এই নিরাশ্রয় মেয়েটির
পাশে আমার সমস্ত মন যেন একেবারে কোমর বেঁধে দাঁড়াল। পরের বাড়িতে পরের অনিচ্ছাতে এসে
আশ্রয় নেওয়া -- সে কতবড়ো অপমান। দায়ে পড়ে সেও যাকে স্বীকার করতে হল, তাকে কি এক পাশে
ঠেলে রাখা যায়।
তার পরে দেখলুম আমার বড়ো জায়ের
দশা। তিনি নিতান্ত দরদে পড়ে বোনটিকে নিজের কাছে এনেছেন। কিন্তু, যখন দেখলেন স্বামীর
অনিচ্ছা, তখন এমনি ভাব করতে লাগলেন, যেন এ তাঁর এক বিষম বালাই , যেন একে দূর করতে পারলেই
তিনি বাঁচেন। এই অনাথা বোনটিকে মন খুলে প্রকাশ্যে স্নেহ দেখালেন, সে সাহস তাঁর হল না।
তিনি পতিব্রতা।
তাঁর এই সংকট দেখে আমার মন
আরো ব্যথিত হয়ে উঠল। দেখলুম , বড়ো জা সকলকে একটু বিশেষ করে দেখিয়ে দেখিয়ে বিন্দুর খাওয়াপরার
এমনি মোটারকমের ব্যবস্থা করলেন এবং বাড়ির সর্বপ্রকার দাসীবৃত্তিতে তাকে এমনভাবে নিযুক্ত
করলেন যে আমার, কেবল দুঃখ নয়, লজ্জা বোধ হল। তিনি সকলের কাছে প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত
যে, আমাদের সংসারে ফাঁকি দিয়ে বিন্দুকে ভারি সুবিধাদরে পাওয়া গেছে। ও কাজ দেয় বিস্তর,
অথচ খরচের হিসাবে বেজায় সস্তা।
আমাদের বড়ো জায়ের বাপের বংশে
কুল ছাড়া আর বড়ো কিছু ছিল না -- রূপও না, টাকাও না। আমার শ্বশুরের হাতে পায়ে ধরে কেমন
করে তোমাদের ঘরে তাঁর বিবাহ হল সে তো সমস্তই জান। তিনি নিজের বিবাহটাকে এ বংশের প্রতি
বিষম একটা অপরাধ বলেই চিরকাল মনে জেনেছেন। সেইজন্যে সকল বিষয়েই নিজেকে যতদূর সম্ভব
সংকুচিত করে তোমাদের ঘরে তিনি অতি অল্প জায়গা জুড়ে থাকেন।
কিন্তু, তাঁর এই সাধু দৃষ্টান্তে
আমাদের বড়ো মুশকিল হয়েছে। আমি সকল দিকে আপনাকে অত অসম্ভব খাটো করতে পারি নে। আমি যেটাকে
ভালো বলে বুঝি আর-কারো খাতিরে সেটাকে মন্দ বলে মেনে নেওয়া আমার কর্ম নয় -- তুমিও তার
অনেক প্রমাণ পেয়েছ ।
বিন্দুকে আমি আমার ঘরে টেনে
নিলুম। দিদি বললেন, 'মেজোবউ গরিবের ঘরের মেয়ের মাথাটি খেতে বসলেন।' আমি যেন একটা বিপদ
ঘটালুম, এমনি ভাবে তিনি সকলের কাছে নালিশ করে বেড়ালেন। কিন্তু, আমি নিশ্চয় জানি, তিনি
মনে মনে বেঁচে গেলেন। এখন দোষের বোঝা আমার উপরেই পড়ল। তিনি বোনকে নিজে যে স্নেহ দেখাতে
পারতেন না আমাকে দিয়ে সেই স্নেহটুকু করিয়ে নিয়ে তাঁর মনটা হালকা হল। আমার বড়ো জা বিন্দুর
বয়স থেকে দু-চারটে অঙ্ক বাদ দিতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু, তার বয়স যে চোদ্দর চেয়ে কম
ছিল না , এ কথা লুকিয়ে বললে অন্যায় হত না। তুমি তো জান, সে দেখতে এতই মন্দ ছিল যে পড়ে
গিয়ে সে যদি মাথা ভাঙত তবে ঘরের মেজেটার জন্যেই লোকে উদ্বিগ্ন হত। কাজেই পিতা-মাতার
অভাবে কেউ তাকে বিয়ে দেবার ছিল না, এবং তাকে বিয়ে করবার মতো মনের জোরই বা কজন লোকের
ছিল।
বিন্দু বড়ো ভয়ে ভয়ে আমার কাছে
এল। যেন আমার গায়ে তার ছোঁয়াচ লাগলে আমি সইতে পারব না। বিশ্বসংসারে তার যেন জন্মাবার
কোনো শর্ত ছিল না; তাই সে কেবলই পাশ কাটিয়ে , চোখ এড়িয়ে চলত। তার বাপের বাড়িতে তার
খুড়তুতো ভাইরা তাকে এমন একটু কোণও ছেড়ে দিতে চায় নি যে-কোন একটা অনাবশ্যক জিনিস পড়ে
থাকতে পারে। অনাবশ্যক আবর্জনা ঘরের আশে-পাশে অনায়াসে স্থান পায়, কেননা মানুষ তাকে ভুলে
যায়, কিন্তু অনাবশ্যক মেয়েমানুষ যে একে অনাবশ্যক আবার তার উপরে তাকে ভোলাও শক্ত, সেইজন্যে
আঁস্তাকুড়েও তার স্থান নেই। অথচ বিন্দুর খুড়তুতো ভাইরা যে জগতে পরমাবশ্যক পদার্থ তা
বলবার জো নেই। কিন্তু, তারা বেশ আছে।
তাই , বিন্দুকে যখন আমার ঘরে
ডেকে আনলুম, তার বুকের মধ্যে কাঁপতে লাগল। তার ভয় দেখে আমার বড়ো দুঃখ হল। আমার ঘরে
যে তার একটুখানি জায়গা আছে, সেই কথাটি আমি অনেক আদর করে তাকে বুঝিয়ে দিলুম।
কিন্তু, আমার ঘর শুধু তো আমারই
ঘর নয়। কাজেই আমার কাজটি সহজ হল না। দু-চারদিন আমার কাছে থাকলেই তার গায়ে লাল-লাল কী
উঠল, হয়তো সে ঘামাচি, নয় তো আর-কিছু হবে। তোমরা বললে বসন্ত। কেননা,ও যে বিন্দু। তোমাদের
পাড়ায় এক আনাড়ি ডাক্তার এসে বললে আর দুই-একদিন না গেলে ঠিক বলা যায় না । কিন্তু সেই
দুই-একদিনের সবুর সইবে কে। বিন্দু তো তার ব্যামোর লজ্জাতেই মরবার জো হল । আমি বললুম,
বসন্ত হয় তো হোক, আমি আমাদের সেই আঁতুড়ঘরে ওকে নিয়ে থাকব, আর-কাউকে কিছু করতে হবে না।
এই নিয়ে আমার উপরে তোমরা যখন সকলে মারমূর্তি ধরেছ, এমন-কি, বিন্দুর দিদিও যখন অত্যন্ত
বিরক্তির ভান করে পোড়াকপালি মেয়েটাকে হাসপাতালে পাঠাবার প্রস্তাব করছেন, এমন সময় ওর
গায়ে সমস্ত লাল দাগ একদম মিলিয়ে গেল। তোমরা দেখি তাতে আরো ব্যস্ত হয়ে উঠলে । বললে,
নিশ্চয় বসন্ত বসে গিয়েছে। কেননা, ও যে বিন্দু ।
অনাদরে মানুষ হবার একটা মস্ত
গুণ শরীরটাকে তাতে একেবারে অজর অমর করে তোলে। ব্যামো হতেই চায় না -- মরার সদর রাস্তাগুলো
একেবারেই বন্ধ। রোগ তাই ওকে ঠাট্টা করে গেল, কিছুই হল না। কিন্তু এটা বেশ বোঝা গেল,
পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে অকিঞ্চিৎকর মানুষকে আশ্রয় দেওয়াই সব চেয়ে কঠিন। আশ্রয়ের দরকার
তার যত বেশি আশ্রয়ের বাধাও তার তেমনি বিষম ।
আমার সম্বন্ধে বিন্দুর ভয়
যখন ভাঙল তখন ওকে আর-এক গেরোয় ধরল। আমাকে এমনি ভালোবাসতে শুরু করলে যে, আমাকে ভয় ধরিয়ে
দিলে। ভালোবাসার এরকম মূর্তি সংসারে তো কোনোদিন দেখি নি। বইয়েতে পড়েছি বটে, সেও মেয়ে
পুরুষের মধ্যে । আমার যে রূপ ছিল সে কথা আমার মনে মরবার কোনো কারণ বহুকাল ঘটে নি
-- এতদিন পরে সেই রূপটা নিয়ে পড়ল এই কুশ্রী মেয়েটি। আমার মুখ দেখে তার চোখের আশ আর
মিটত না। বলত, 'দিদি, তোমার এই মুখখানি আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় নি।' যেদিন আমি নিজের
চুল নিজে বাঁধতুম , সেদিন তার ভারি অভিমান। আমার চুলের বোঝা দুই হাত দিয়ে নাড়তে-চাড়তে
তার ভারি ভালো লাগত। কোথাও নিমন্ত্রণে যাওয়া ছাড়া আমার সাজগোজের তো দরকার ছিল না ।
কিন্তু, বিন্দু আমাকে অস্থির করে রোজই কিছু না-কিছু সাজ করাত। মেয়েটা আমাকে নিয়ে একেবারে
পাগল হয়ে উঠল।
তোমাদের অন্দরমহলে কোথাও জমি
এক ছটাক নেই। উত্তরদিকের পাঁচিলের গায়ে নর্দমার ধারে কোনোগতিকে একটা গাবগাছ জন্মেছে।
যেদিন দেখতুম সেই গাবের গাছের নতুন পাতাগুলি রাঙা টকটকে হয়ে উঠেছে, সেইদিন জানতুম,
ধরাতলে বসন্ত এসেছে বটে। আমার ঘরকন্নার মধ্যে ঐ অনাদৃত মেয়েটার চিত্ত যেদিন আগা গোড়া
এমন রঙিন হয়ে উঠল সেদিন আমি বুঝলুম হৃদয়ের জগতেও একটা বসন্তের হাওয়া আছে -- সে কোন্
স্বর্গ থেকে আসে, গলির মোড় থেকে আসে না ।
বিন্দুর ভালোবাসার দুঃসহ বেগে
আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। এক একবার তার উপর রাগ হত, সেকথা স্বীকার করি, কিন্তু তার
এই ভালোবাসার ভিতর দিয়ে আমি আপনার একটি স্বরূপ দেখলুম যা আমি জীবনে আর কোনোদিন দেখি
নি। সেই আমার মুক্ত স্বরূপ।
এদিকে, বিন্দুর মতো মেয়েকে
আমি যে এতটা আদরযত্ন করছি, এ তোমাদের অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বলে ঠেকল। এর জন্যে খুঁতখুঁত-খিটখিটের
অন্ত ছিল না। যেদিন আমার ঘর থেকে বাজুবন্ধ চুরি গেল, সেদিন সেই চুরিতে বিন্দুর যে কোনোরকমের
হাত ছিল, এ কথার আভাস দিতে তোমাদের লজ্জা হল না। যখন স্বদেশী হাঙ্গামায় লোকের বাড়িতল্লাসি
হতে লাগল তখন তোমার অনায়াসে সন্দেহ করে বসলে যে, বিন্দুরা পুলিসের পোষা মেয়েচর। তার
আর কোনো প্রমাণ ছিল না কেবল এই প্রমাণ যে,ও বিন্দু।
তোমাদের বাড়ির দাসীরা ওর কোনোরকম
কাজ করতে আপত্তি করত -- তাদের কাউকে ওর কাজ করবার ফরমাশ করলে, ও-মেয়েও একেবারে সংকোচে
যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠত। এই-সকল কারণেই ওর জন্যে আমার খরচ বেড়ে গেল। আমি বিশেষ করে একজন
আলাদা দাসী রাখলুম। সেটা তোমাদের ভালো লাগে নি। বিন্দুকে আমি যে-সব কাপড় পরতে দিতুম
তা দেখে এত রাগ করেছিলে যে, আমার হাত-খরচের টাকা বন্ধ করে দিলে। তার পরদিন থেকে আমি
পাঁচ-সিকে দামের জোড়া মোটা কোরা কলের ধুতি পরতে আরম্ভ করে দিলুম। আর, মতির মা যখন আমার
এঁটো ভাতের থালা নিয়ে যেতে এল, তাকে বারণ করে দিলুম। আমি নিজে উঠোনের কলতলায় গিয়ে এঁটো
ভাত বাছুরকে খাইয়ে বাসন মেজেছি। একদিন হঠাৎ সেই দৃশ্যটি দেখে তুমি খুব খুশি হও নি।
আমাকে খুশি না করলেও চলে আর তোমাদের খুশি না করলেই নয় , এই সুবুদ্ধিটা আজ পর্যন্ত আমার
ঘটে এল না।
এদিকে তোমাদের রাগও যেমন বেড়ে
উঠেছে বিন্দুর বয়সও তেমনি বেড়ে চলেছে। সেই স্বাভাবিক ব্যাপারে তোমরা অস্বাভাবিক রকমের
বিব্রত হয়ে উঠেছিল। একটা কথা মনে করে আমি আশ্চর্য হই, তোমরা জোর করে কেন বিন্দুকে তোমাদের
বাড়ি থেকে বিদায় করে দাও নি। আমি বেশ বুঝি, তোমরা আমাকে মনে মনে ভয় কর। বিধাতা যে আমাকে
বুদ্ধি দিয়েছিলেন, ভিতরে ভিতরে তার খাতির না করে তোমরা বাঁচ না।
অবশেষে বিন্দুকে নিজের শক্তিতে
বিদায় করতে না পেরে তোমরা প্রজাপতি দেবতার শরণাপন্ন হলে। বিন্দুর বর ঠিক হল। বড়ো জা
বললেন, 'বাঁচলুম , মা কালী আমাদের বংশের মুখ রক্ষা করলেন।'
বর কেমন তা জানি নে;তোমাদের
কাছে শুনলুম, সকল বিষয়েই ভালো। বিন্দু আমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল; বললে, 'দিদি
আমার আবার বিয়ে করা কেন।'
আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে বললুম,
'বিন্দু, তুই ভয় করিস নে -- শুনেছি, তোর বর ভালো।'
বিন্দু বললে, 'বর যদি ভালো
হয়, আমার কী আছে যে আমাকে তার পছন্দ হবে।'
বরপক্ষেরা বিন্দুকে তো দেখতে
আসবার নামও করলে না। বড়দিদি তাতে বড়ো নিশ্চিন্ত হলেন।
কিন্তু, দিনরাত্রে বিন্দুর
কান্না আর থামতে চায় না। সে তার কী কষ্ট, সে আমি জানি। বিন্দুর জন্যে আমি সংসারে অনেক
লড়াই করেছি কিন্তু, ওর বিবাহ বন্ধ হোক এ কথা বলবার সাহস আমার হল না। কিসের জোরেই বা
বলব। আমি যদি মারা যাই তো ওর কী দশা হবে। একে তো মেয়ে, তাতে কালো মেয়ে -- কার ঘরে চলল,
ওর কী দশা হবে, সে কথা না ভাবাই ভালো। ভাবতে গেলে প্রাণ কেঁপে ওঠে।
বিন্দু বললে, 'দিদি, বিয়ের
আর পাঁচদিন আছে, এর মধ্যে আমার মরণ হবে না কি।'
আমি তাকে খুব ধমকে দিলুম,
কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি কোনো সহজভাবে বিন্দুর মৃত্যু হতে পারত তা হলে আমি আরাম
বোধ করতুম।
বিবাহের আগের দিন বিন্দু তার
দিদিকে গিয়ে বললে,'দিদি,আমি তোমাদের গোয়ালঘরে পড়ে থাকব, আমাকে যা বলবে তাই করব,তোমার
পায়ে পড়ি আমাকে এমন করে ফেলে দিয়ো না।'
কিছুকাল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে
দিদির চোখ দিয়ে জল পড়ছিল, সেদিনও পড়ল। কিন্তু,শুধু হৃদয় তো নয়,শাস্ত্রও আছে। তিনি বললেন
, 'জানিস তো,বিন্দি,পতিই হচ্ছে স্ত্রীলোকের গতি মুক্তি সব। কপালে যদি দুঃখ থাকে তো
কেউ খণ্ডাতে পারবে না।'
আসল কথা হচ্ছে,কোনো দিকে কোনো
রাস্তাই নেই -- বিন্দুকে বিবাহ করতেই হবে, তার পরে যা হয় তা হোক।
আমি চেয়েছিলুম,বিবাহটা যাতে
আমাদের বাড়িতেই হয়। কিন্তু, তোমরা বলে বসলে,বরের বাড়িতেই হওয়া চাই -- সেটা তাদের কৌলিক
প্রথা।
আমি বুঝলুম, বিন্দুর বিবাহের
জন্য যদি তোমাদের খরচ করতে হয়, তবে সেটা তোমাদের গৃহদেবতার কিছুতেই সইবে না। কাজেই
চুপ করে যেতে হল। কিন্তু, একটি কথা তোমরা কেউ জান না। দিদিকে জানবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু
জানাই নি, কেননা তা হলে তিনি ভয়েই মরে যেতেন -- আমার কিছু কিছু গয়না দিয়ে আমি লুকিয়ে
বিন্দুকে সাজিয়ে দিয়েছিলুম। বোধকরি দিদির চোখে সেটা পড়ে থাকবে,কিন্তু সেটা তিনি দেখেও
দেখেন নি। দোহাই ধর্মের,সেজন্য তোমরা তাঁকে ক্ষমা কোরো।
যাবার আগে বিন্দু আমাকে জড়িয়ে
ধরে বললে, 'দিদি, আমাকে তোমরা তা হলে নিতান্তই ত্যাগ করলে?'
আমি বললুম 'না বিন্দি,তোর
যেমন দশাই হোক-না কেন, আমি তোকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করব না ।'
তিন দিন গেল। তোমাদের তালুকের
প্রজা খাবার জন্যে তোমাকে যে ভেড়া দিয়েছিল, তাকে তোমার জঠরাগ্নি থেকে বাঁচিয়ে আমি আমাদের
একতলায় কয়লা-রাখবার ঘরের এক পাশে বাস করতে দিয়েছিলুম। সকালে উঠেই আমি নিজে তাকে দানা
খাইয়ে আসতুম; তোমার চাকরদের প্রতি দুই-একদিন নির্ভর করে দেখেছি, তাকে খাওয়ানোর চেয়ে
তাকে খাওয়ার প্রতিই তাদের বেশি ঝোঁক।
সেদিন সকালে সেই ঘরে ঢুকে
দেখি, বিন্দু এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে । আমাকে দেখেই আমার পা জড়িয়ে ধরে লুটিয়ে পড়ে
নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল ।
বিন্দুর স্বামী পাগল।
'সত্যি বলছিস, বিন্দি?'
'এত বড়ো মিথ্যা কথা তোমার
কাছে বলতে পারি, দিদি? তিনি পাগল। শ্বশুরের এই বিবাহে মত ছিল না -- কিন্তু তিনি আমার
শাশুড়িকে যমের মতো ভয় করেন। তিনি বিবাহের পূর্বেই কাশী চলে গেছেন। শাশুড়ি জেদ করে তাঁর
ছেলের বিয়ে দিয়েছেন।'
আমি সেই রাশ-করা কয়লার উপরে
বসে পড়লুম। মেয়েমানুষকে মেয়েমানুষ দয়া করে না। বলে,'ও তো মেয়েমানুষ বই তো নয়। ছেলে
হোক-না পাগল, সে তো পুরুষ বটে।'
বিন্দুর স্বামীকে হঠাৎ পাগল
বলে বোঝা যায় না, কিন্তু এক-একদিন সে এমন উন্মাদ হয়ে ওঠে যে, তাকে ঘরে তালাবন্ধ করে
রাখতে হয়। বিবাহের রাত্রে সে ভালো ছিল কিন্তু রাত-জাগা প্রভৃতি উৎপাতে দ্বিতীয় দিন
থেকে তার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে উঠল। বিন্দু দুপুরবেলায় পিতলের থালায় ভাত খেতে বসেছিল,হঠাৎ
তার স্বামী থালাসুদ্ধ ভাত টেনে উঠোনে ফেলে দিল। হঠাৎ কেমন তার মনে হয়েছে, বিন্দু স্বয়ং
রানী রাসমণি; বেহারাটা নিশ্চয় সোনার থালা চুরি করে রাণীকে তার নিজের থালায় ভাত খেতে
দিয়েছে। এই তার রাগ। বিন্দু তো ভয়ে মরে গেল। তৃতীয় রাত্রে শাশুড়ি তাকে যখন স্বামীর
ঘরে শুতে বললে, বিন্দুর প্রাণ শুকিয়ে গেল। শাশুড়ি তার প্রচন্ড, রাগলে জ্ঞান থাকে না।
সেও পাগল, কিন্তু পুরো নয় বলেই আরো ভয়ানক। বিন্দুকে ঘরে ঢুকতে হল। স্বামী সে রাত্রে
ঠাণ্ডা ছিল। কিন্তু , ভয়ে বিন্দুর শরীর যেন কাঠ হয়ে গেল। স্বামী যখন ঘুমিয়েছে অনেক
রাত্রে সে অনেক কৌশলে পালিয়ে চলে এসেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ লেখবার দরকার নেই।
ঘৃণায় রাগে আমার সকল শরীর
জ্বলতে লাগল। আমি বললুম, 'এমন ফাঁকির বিয়ে বিয়েই নয়। বিন্দু, তুই যেমন ছিলি তেমনি আমার
কাছে থাক্, দেখি তোকে কে নিয়ে যেতে পারে।'
তোমরা বললে, 'বিন্দু মিথ্যা
কথা বলছে।'
আমি বললুম , 'ও কখনো মিথ্যা
বলে নি।'
তোমরা বললে, 'কেমন করে জানলে।'
আমি বললুম,'আমি নিশ্চয় জানি।'
তোমরা ভয় দেখালে, 'বিন্দুর
শ্বশুরবাড়ির লোকে পুলিস-কেস করলে মুশকিলে পড়তে হবে।'
আমি বললুম,'ফাঁকি দিয়ে পাগল
বরের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছে এ কথা কি আদালত শুনবে না।'
তোমরা বললে,'তবে কি এই নিয়ে
আদালত করতে হবে নাকি । কেন, আমাদের দায় কিসের ।'
আমি বললুম, 'আমি নিজের গয়না
বেচে যা করতে পারি করব ।'
তোমরা বললে,'উকিল বাড়ি ছুটবে
নাকি ।'
এ কথার জবাব নেই । কপালে করাঘাত
করতে পারি, তার বেশি আর কী করব ।
ওদিকে বিন্দুর শ্বশুড়বাড়ি
থেকে ওর ভাসুর এসে বাইরে বিষম গোল বাধিয়েছে । সে বলছে, সে থানায় খবর দেবে ।
আমার যে কি জোর আছে জানি নে
-- কিন্তু কসাইয়ের হাত থেকে যে গরু প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে আমার আশ্রয় নিয়েছে তাকে পুলিসের
তাড়ায় আবার মন মানতে পারল না । আমি স্পর্ধা করে বললুম,'তারা দিক্ থানায় খবর ।'
এই ব'লে মনে করলুম, বিন্দুকে
এইবেলা আমার শোবার ঘরে এনে তাকে নিয়ে তালাবদ্ধ করে বসে থাকি । খোঁজ করে দেখি , বিন্দু
নেই । তোমাদের সঙ্গে আমার বাদপ্রতিবাদ যখন চলছিল তখন বিন্দু আপনি বাইরে গিয়ে তার ভাসুরের
কাছে ধরা দিয়েছে । বুঝেছি, এ বাড়িতে যদি সে থাকে তবে আমাকে সে বিষম বিপদে ফেলবে ।
মাঝখানে পালিয়ে এসে বিন্দু
আপন দুঃখ আরও বাড়ালে । তার শাশুড়ির তর্ক এই যে। তার ছেলে তো ওকে খেয়ে ফেলছিল না । মন্দ
স্বামীর দৃষ্টান্ত সংসারে দুর্লভ নয়, তাদের সঙ্গে তুলনা করলে তার ছেলে যে সোনার চাঁদ
।
আমার বড়ো জা বললেন, 'ওর পোড়া
কপাল, তা নিয়ে দুঃখ করে কী করব । তা পাগল হোক, ছাগল হোক, স্বামী তো বটে ।'
কুষ্টরোগীকে কোলে করে তার
স্ত্রী বেশ্যার বাড়িতে নিজে পৌছে দিয়েছে, সতীসাধ্বীর সেই দৃষ্টান্ত, তোমাদের মনে জাগছিল;
জগতের মধ্যে অধমতম কাপুরুষতার এই গল্পটা প্রচার করে আসতে তোমাদের পুরুষের মনে আজ পর্যন্ত
একটুও সংকোচবোধ হয় নি, সেইজন্যই মানবজন্ম নিয়েও বিন্দুর ব্যবহারে তোমরা রাগ করতে পেরেছ,
তোমাদের মাথা হেঁটে হয় নি । বিন্দুর জন্যে আমার বুক ফেটে গেল কিন্তু তোমাদের জন্যে
আমার লজ্জার সীমা ছিল না । আমি তো পাড়াগেঁয়ে মেয়ে,তার উপরে তোমাদের ঘরে পড়েছি, ভগবান
কোন্ ফাঁক দিয়ে আমার মধ্যে এমন বুদ্ধি দিলেন । তোমাদের এই-সব ধর্মের কথা আমি যে কিছুতেই
সইতে পারলুম না ।
আমি নিশ্চয় জানতুম, মরে গেলেও
বিন্দু আমাদের ঘরে আর আসবে না, কিন্তু আমি যে তাকে বিয়ের আগের দিন আশা দিয়েছিলুম যে,
তাকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করব না। আমার ছোটো ভাই শরৎ কলকাতায় কলেজে পড়ছিল; তোমরা জানই
তো যতরকমের ভলন্টিয়ারি করা,প্লেগের পাড়ার ইঁদুর মারা,দামোদরের বন্যায় ছোটা, এতেই তার
এত উৎসাহ যে উপরি উপরি দুবার সে এফ.এ. পরীক্ষায় ফেল করেও কিছুমাত্র দমে যায় নি। তাকে
আমি ডেকে বললুম,'বিন্দুর খবর যাতে আমি পাই তোকে সেই বন্দোবস্ত করে দিতে হবে, শরৎ। বিন্দু
আমাকে চিঠি লিখতে সাহস করবে না, লিখলেও আমি পাব না।'
এরকম কাজের চেয়ে যদি তাকে
বলতুম, বিন্দুকে ডাকাতি করে আনতে কিম্বা তার পাগল স্বামীর মাথা ভেঙে দিতে তা হলে বেশি
খুশি হত।
শরতের সঙ্গে আলোচনা করছি এমন
সময় তুমি ঘরে এসে বললে, 'আবার কী হাঙ্গামা বাধিয়েছ।'
আমি বললুম, 'সেই যা-সব গোড়ায়
বাধিয়েছিলুম, তোমাদের ঘরে এসেছিলুম --কিন্তু সে তো তোমাদেরই কীর্তি।'
তুমি জিজ্ঞাসা করলে, 'বিন্দুকে
আবার এনে কোথাও লুকিয়ে রেখেছ?'
আকি বললুম,'বিন্দু যদি আসত
তা হলে নিশ্চয় এনে লুকিয়ে রাখতুম। কিন্তু সে আসবে না, তোমাদের ভয় নেই ।'
শরৎকে আমার কাছে দেখে তোমার
সন্দেহ আরো বেড়ে উঠল। আমি জানতুম, শরৎ আমাদের বাড়ি যাতায়াত করে, এ তোমরা কিছুতেই পছন্দ
করতে না। তোমাদের ভয় ছিল, ওর 'পরে পুলিসের দৃষ্টি আছে -- কোন্ দিন ও কোন্ রাজনৈতিক
মামলায় পড়বে, তখন তোমাদের সুদ্ধ জড়িয়ে ফেলবে। সেইজন্যে আমি ওকে ভাইফোঁটা পর্যন্ত লোক
দিয়ে পাঠিয়ে দিতুম, ঘরে ডাকতুম না।
তোমার কাছে শুনলুম, বিন্দু
আবার পালিয়েছে, তাই তোমাদের বাড়িতে তার ভাসুর খোঁজ করতে এসেছে। শুনে আমার বুকের মধ্যে
শেল বিঁধল। হতভাগিনীর যে কী অসহ্য কষ্ট তা বুঝলুম অথচ কিছুই করবার রাস্তা নেই ।
শরৎ খবর নিতে ছুটল। সন্ধ্যার
সময় ফিরে এসে আমাকে বললে, বিন্দু তার খুড়তুতো ভাইদের বাড়ি গিয়েছিল, কিন্তু তারা তুমুল
রাগ করে তখনই আবার তাকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে। এর জন্যে তাদের খেসারত এবং গাড়িভাড়া
দন্ড যা ঘটেছে, তার ঝাঁজ এখনো তাদের মন থেকে মরে নি।
তোমাদের খুড়িমা শ্রীক্ষেত্রে
তীর্থ করতে যাবেন বলে তোমাদের বাড়িতে এসে উঠেছেন। আমি তোমাদের বললুম, 'আমিও যাব।'
আমার হঠাৎ এমন ধর্মে মন হয়েছে
দেখে তোমরা এত খুশি হয়ে উঠলে যে, কিছুমাত্র আপত্তি করলে না। এ কথাও মনে ছিল যে,এখন
যদি কলকাতায় থাকি তবে আবার কোন্ দিন বিন্দুকে নিয়ে ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসব। আমাকে নিয়ে
বিষম ল্যাঠা।
বুধবার আমাদের যাবার দিন,
রবিবারে সমস্ত ঠিক হল। আমি শরৎকে ডেকে বললুম,'যেমন করে হোক, বিন্দুকে বুধবারে পুরী
যাবার গাড়িতে তোকে তুলে দিতে হবে।'
শরতের মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠল;
সে বললে, 'ভয় নেই, দিদি, আমি তাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে পুরী পর্যন্ত চলে যাব। -- ফাঁকি
দিয়ে জগন্নাথ দেখা হয়ে যাবে। '
সেইদিন সন্ধ্যার সময় শরৎ আবার
এল। তার মুখ দেখেই আমার বুক দমে গেল। আমি বললুম,'কী,শরৎ? সুবিধা হল না বুঝি?'
সে বললে, না।'
আমি বললুম,'রাজি করতে পারলি
নে? '
সে বললে,'আর দরকার নেই। কাল
রাত্তিরে সে কাপড়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে মরেছে। বাড়ির যে ভাইপোটার সঙ্গে ভাব করে
নিয়েছিলুম, তার কাছে খবর পেলুম, তোমার নামে সে একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল, কিন্তু সে চিঠি
ওরা নষ্ট করেছে।'
যাক, শান্তি হল।
দেশসুদ্ধ লোক চটে উঠল। বলতে
লাগল,'মেয়েদের কাপড়ে আগুন লাগিয়ে মরা একটা ফ্যাশান হয়েছে।'
তোমরা বললে, 'এ-সমস্ত নাটক
করা।' তা হবে। কিন্তু নাটকের তামাশাটা কেবল বাঙালি মেয়েদের উপর দিয়েই হয় কেন, আর বাঙালি
বীরপুরুষদের কোঁচার উপর দিয়ে হয় না কেন, সেটাও তো ভেবে দেখা উচিত।
বিন্দিটার এমনি পোড়া কপাল
বটে! যতদিন বেঁচে ছিল রূপে গুণে কোনো যশ পায় নি -- মরবার বেলাও যে একটু ভেবে চিন্তে
এমন একটা নতুন ধরনে মরবে যাতে দেশের পুরুষরা খুশি হয়ে হাততালি দেবে তাও তার ঘটে এল
না। মরেও লোকদের চটিয়ে দিলে!
দিদি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে কাঁদলেন।
কিন্তু সে কান্নার মধ্যে একটা সান্ত্বনা ছিল। যাই হোক্-না কেন, তবু রক্ষা হয়েছে, মরেছে
বই তো না! বেঁচে থাকলে কী না হতে পারত।
আমি তীর্থে এসেছি। বিন্দুর
আর আসবার দরকার হল না, কিন্তু আমার দরকার ছিল।
দুঃখ বলতে লোকে যা বোঝে তোমাদের
সংসারে তা আমার ছিল না। তোমাদের ঘরে খাওয়া-পরা অসচ্ছল নয়;তোমার দাদার চরিত্র যেমন হোক,
তোমার চরিত্রে এমন কোনো দোষ নেই যাতে বিধাতাকে মন্দ বলতে পারি। যদি বা তোমার স্বভাব
তোমার দাদার মতোই হত তা হলে হয়তো মোটের উপর আমার এমনি ভাবেই দিন চলে যেত এবং আমার সতীসাধ্বী
বড়ো জায়ের মতো পতিদেবতাকে দোষ না দিয়ে বিশ্বদেবতাকেই আমি দোষ দেবার চেষ্টা করতুম। অতএব
তোমাদের নামে আমি কোনো নালিশ উত্থাপন করতে চাই নে -- আমার এ চিঠি সেজন্যে নয়।
কিন্তু আমি আর তোমাদের সেই
সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে ফিরব না। আমি বিন্দুকে দেখেছি সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের
পরিচয়টা যে কী তা আমি পেয়েছি। আর আমার দরকার নেই ।
তার পরে এও দেখেছি, ও মেয়ে
বটে তবু ভগবান ওকে ত্যাগ করেন নি। ওর উপরে তোমাদের যত জোরই থাক্-না কেন, সে জোরের
অন্ত আছে। ও আপনার হতভাগ্য মানবজন্মের চেয়ে বড়ো। তোমরাই যে আপন ইচ্ছামতো আপন দস্তুর
দিয়ে ওর জীবনটাকে চিরকাল পায়ের তলায় চেপে রেখে দেবে, তোমাদের পা এত লম্বা নয়। মৃত্যু
তোমাদের চেয়ে বড়ো। সেই মৃত্যুর মধ্যে সে মহান -- সেখানে বিন্দু কেবল বাঙালি ঘরের মেয়ে
নয়, কেবল খুড়ততো ভায়ের বোন নয়, কেবল অপরিচিত পাগল স্বামীর প্রবঞ্চিত স্ত্রী নয়। সেখানে
সে অনন্ত।
সেই মৃত্যুর বাঁশি এই বালিকার
ভাঙা হৃদয়ের ভিতর দিয়ে আমার জীবনের যমুনাপারে যেদিন বাজল সেদিন প্রথমটা আমার বুকের
মধ্যে যেন বাণ বিঁধল। বিধাতাকে জিজ্ঞাসা করলুম, জগতের মধ্যে যা-কিছু সব চেয়ে তুচ্ছ
তাই সব চেয়ে কঠিন কেন? এই গলির মধ্যকার চারি-দিকে-প্রাচীর-তোলা নিরানন্দের অতি সামান্য
বুদ্বুদটা এমন ভয়ংকর বাধা কেন। তোমার বিশ্বজগৎ তার ছয় ঋতুর সুধাপাত্র হাতে করে যেমন
করেই ডাক দিক-না, এক মুহূর্তের জন্যে কেন আমি এই অন্দরমহলটার এইটুকু মাত্র চৌকাঠ পেরতে
পারি নে। তোমার এমন ভুবনে আমার এমন জীবন নিয়ে কেন ঐ অতি তুচ্ছ ইটঁকাঠের আড়ালটার মধ্যেই
আমাকে তিলে তিলে মরতেই হবে। কত তুচ্ছ আমার এই প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, কত তুচ্ছ এর সমস্ত
বাঁধা নিয়ম, বাঁধা অভ্যাস, বাঁধা বুলি, এর সমস্ত বাঁধা মার -- কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই
দীনতার নাগপাশ বন্ধনেরই হবে জিত -- আর হার হল তোমার নিজের সৃষ্টি ঐ আনন্দলোকের?
কিন্তু মৃত্যুর বাঁশি বাজাতে
লাগল -- কোথায় রে রাজমিস্ত্রির গড়া দেয়াল, কোথায় রে তোমাদের ঘোরো আইন দিয়ে গড়া কাঁটার
বেড়া; কোন্ দুঃখে কোন্ অপমানে মানুষকে বন্দী করে রেখে দিতে পারে! ঐ তো মৃত্যুর হাতে
জীবনের জয়পতাকা উড়ছে! ওরে মেজোবউ, ভয় নেই তোর! তোর মেজবউয়ের খোলস ছিন্ন হতে এক নিমেষও
লাগে না।
তোমাদের গলিকে আর আমি ভয় করি
নে। আমার সম্মুখে আজ নীল সমুদ্র, আমার মাথার উপরে আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ।
তোমাদের অভ্যাসের অন্ধকারে
আমাকে ঢেকে রেখে দিয়েছিলে। ক্ষণকালের জন্য বিন্দু এসে সেই আবরণের ছিদ্র দিয়ে আমাকে
দেখে নিয়েছিল। সেই মেয়েটাই তার আপনার মৃত্যু দিয়ে আবরণখানা আগাগোড়া ছিন্ন করে দিয়ে
গেল। আজ বাইরে এসে দেখি, আমার গৌরব রাখবার আর জায়গা নেই। আমার এই আনাদৃত রূপ যাঁর চোখে
ভালো লেগেছে, সেই সুন্দর সমস্ত আকাশ দিয়ে আমাকে চেয়ে দেখছেন। এইবার মরেছে মেজোবউ।
তুমি ভাবছ আমি মরতে যাচ্ছি--
ভয় নেই, অমন পুরোনো ঠাট্টা তোমাদের সঙ্গে আমি করব না। মীরাবাঈও তো আমারই মতো মেয়েমানুষ
ছিল-- তার শিকলও তো কম ভারী ছিল না তাকে তো বাঁচবার জন্যে মরতে হয় নি। মীরাবাঈ তার
গানে বলেছিল,'ছাড়ুক বাপ, ছাড়ুক মা, ছাড়ুক যে যেখানে আছে, মীরা কিন্তু লেগেই রইল, প্রভু--
তাতে তার যা হবার তা হোক।' এই লেগে থাকাই তো বেঁচে থাকা। আমিও বাঁচব। আমি বাঁচলুম।
তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন-
-মৃণাল।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।