প্রশ্নঃ ভারতের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো। ভারতের ইতিহাসে তাদের প্রভাব আলোচনা করো।
অথবা
ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব আলোচনা করো।
**********************************************
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে ভারতকে ভৌগোলিক দিক থেকে
পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- (i) উত্তরাপথ – উত্তর-পশ্চিম ভারত, (ii) মধ্যদেশ —
গাঙ্গেয় উপত্যকা, (iii) অপরান্ত বা প্রতীচ্য-পশ্চিম ভারত, (iv) প্রাচ্য – পূর্বদেশ
বা পূর্ব ভারত, (v) দক্ষিণাপথ বা দাক্ষিণাত্য। নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল—
(i)উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল বা হিমালয়ঃ
ভারতের উত্তর-পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর- পূর্বে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয় অবস্থিত,
যার দৈর্ঘ্য 2560 কিমি এবং প্রস্থ। 320 কিমি। এটি পামীর মালভূমি থেকে উত্থিত হয়ে পূর্বে
অনুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
(ii)সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাঃ
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে মধ্য ভারতের মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত সিন্ধু, গঙ্গা
ও ব্রহ্মপুত্র নদীর উপত্যকা যা 'উত্তর ভারতের সমভূমি' নামেও পরিচিত। সমগ্র এলাকাটি
পূর্ব-পশ্চিমে 2500 কিমি এবং উত্তর-দক্ষিণে 240-320 কিমি বিস্তৃত।
(iii)মধ্যভারতের মালভূমিঃ
সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে বিশ্বা
পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা মধ্য ভারতের মালভূমি নামে পরিচিত। বিধ্য পর্বতমালা
উত্তর ভারতকে দাক্ষিণাত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
(iv)দক্ষিণ ভারতের মালভূমিঃ
বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ থেকে কুয়া, ভুলাভদ্রা নদীর উত্তরের ভূভাগ পর্যন্ত অঞ্চল দক্ষিণ
ভারতের মালভূমি নামে পরিচিত। মহারাষ্ট্র, কণটিক, অন্ধ্রপ্রদেশ ও পশ্চিমঘাট পর্বতমালা
এই মালভূমির অন্তর্ভূক্ত।
(v)সুদূর দক্ষিণঃ
দাক্ষিণাত্যের মালভূমির দক্ষিণে অর্থাৎ কৃয়া, তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ থেকে ভারত মহাসাগরের
উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত এই সময় অঞ্চলটি 'সুদূর দক্ষিণ' নামে পরিচিত।
এটি ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব
ভারতের ইতিহাস তথা সভ্যতার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে
তার ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাব অপরিসীম। পর্বতমালা, নদ-নদী, সমুদ্র ও প্রাকৃতিক সম্পদ
ভারতীয় ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
1. হিমালয়ের প্রভাবঃ
ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে হিমালয়ের গুরুত্ব ও প্রভাব অপরিসীম। (i) এই দুর্লঙ্ঘ্য
হিমালয় ও তার শাখাপ্রশাখা এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভারতকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে
এবং ভারতে বিকশিত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতি (ii) হিমালয় যুগ যুগ ধরে
একটি রক্ষাপ্রচীর স্বরূপ দণ্ডায়মান। যার ফলে বিদেশি আক্রমণ সহজ হয়নি এবং ভারত রক্ষা
পেয়েছে। (iii) হিমালয় ভারতের জলবায়ুকে দু-ভাবে প্রভাবিত করেছে। মধ্য এশিয়ার শীতল
আবহাওয়াকে প্রতিহত করে উত্তর ভারতের জলবায়ুকে নাতিশীতোয় রেখেছে, আবার সমুদ্র থেকে
প্রভাবিত মৌসুমি বায়ু হিমালয়ের বুকে প্রতিহত হয়ে উত্তর ভারতে বৃষ্টিপাত ঘটায়।
(iv) সিন্ধু গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য অসংখ্য নদ-নদীর উৎপত্তিস্থল হল হিমালয়।
এই মূল নদীগুলি উত্তর ভারতের সমতলভূমিকে করেছে শস্যশ্যামলা। (v) হিমালয়ের বুকে জমে
থাকা ভেষজ, বনজ, খনিজ ও প্রাণীজ সম্পদ ভারতীয় অর্থনীতিকে নানাভাবে পুষ্ট করেছে।
(vi) 'দেবতাত্মা হিমালয়' হল ভারতীয় ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতীক। ভারতবাসীর ধর্মজীবনে
হিমালয়ের দান প্রচুর। এইসব কারণে ভারতকে 'হিমালয়ের দান' বললে অত্যুক্তি হবে না।
2. বিন্ধ্য পর্বতমালার প্রভাবঃ
(i) বিদ্ধ্য পর্বতমালা ভারতকে উত্তর ও দক্ষিণ বা আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্য—এই
দু-ভাগে বিভক্ত করেছে। এই জন্য প্রাচীন ভারতে কোনো অখণ্ড রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা সম্ভব
হয়নি। (ii) উত্তর ভারত বারবার বিদেশি শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলেও দাক্ষিণাত্য তার
হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। (iii) হিমালয়ের অবস্থানের জন্যই দাক্ষিণাত্যে আর্য সংস্কৃতি
সহজে প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে পৃথক দ্রাবিড় সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
3. সমুদ্রের প্রভাবঃ
ভারতের দক্ষিণাঞ্চল তিনদিকে সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ার প্রভাব ভারতের ইতিহাসের ওপর পড়েছে।
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের পূর্বে জলপথে কোনো বৈদেশিক আক্রমণ
ঘটেনি। অপরদিকে সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতের সঙ্গে পশ্চিমে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্বে দূরপ্রাচ্যে
বাণিজ্যিক যোগাযোগ সমুদ্রপথেই সংঘটিত হয়েছে। ভারতীয় বণিক পণ্যসম্ভার নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ায় পাড়ি দিয়েছে এবং তারা জাভা, সুমাত্রা, মালয় ও ইন্দোচিনে ভারতীয় সংস্কৃতির
প্রসার ঘটায়।
4. নদ-নদীর প্রভাবঃ
ভারত ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে নদ-নদীর ভূমিকা সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সিন্ধু নদকে
ঘিরে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা এবং সিন্ধু, সরস্বতী ও পাঞ্জাবে পাঁচটি নদীকে ঘিরেই
সপ্তসিন্ধু এলাকায় আর্য সভ্যতার সূচনা হয়। গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চলই ছিল ভারতের
প্রথম রাজকীয় শক্তির উৎপত্তি। সাল। অন্যদিকে গোদাবরী, কৃয়া, তুঙ্গভদ্রা নদী দক্ষিণ
ভারতীয় ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রার রায়চুর দোয়াবের অধিকার
নিয়ে বহুদিনব্যাপী পল্লব ও চালুক্য এবং বাহমনী ও বিজনয়নগরের মধ্যে ঐতিহাসিক লড়াই
চলেছিল। এ ছাড়া কৃষির উন্নতি, বাণিজ্যের প্রসার, যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নদীগুলির
গুরুত্ব অপরিসীম। উত্তর ভারতের নদী উপকূলেই গড়ে উঠেছে হরিদ্বার, পাটলিপুত্র, প্রয়াগ,
কনৌজ, এলাহাবাদ, বারাণসী, দিল্লি, আগ্রার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
5.প্রাকৃতিক সম্পদের প্রভাবঃ
সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ ভারতের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। ভারতের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল
এক সময় আর্যদের বাসস্থান। ছিল। সেখানে থেকেও বৈদিক ঋষিগণ রচনা করেন বিশাল বৈদিক সাহিত্য।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে লোহা, তামা, সিসা, সোনা ও মূল্যবান পাথরের মতো
খনিজ পদার্থ। মগধের উত্থানের অন্যতম কারণ ছিল ওই অঞ্চলের প্রাপ্ত প্রচুর পরিমাণে খনিজ
পদার্থ। মধ্য ভারত ও ওড়িশায় প্রাপ্ত মূল্যবান পাথর ভারতের রপ্তানি পণ্যের অন্যতম
ছিল।
মূল্যায়ন পরিশেষে বলা যায়, একটি
দেশের ইতিহাসের ওপর সেই দেশের ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে তার পাশাপাশি
দরকার মানুষের উদ্যম, কর্মপ্রচেষ্টা ও সংগ্রামী মনোভাব এবং সর্বশেষে দরকার অনুকূল পরিবেশের,
যা ইতিহাসকে সহজে বদলে দিতে পারে।
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই
আমাদের প্রতিশ্রুতি
6295916282; 7076398606
জ্ঞ্যানজ্যোতি কোচিং সেন্টার
তোমাদের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব আমরা, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি
অনলাইনে কোচিং নিতে হলে এবং বিভিন্ন নোট নিতে হলে এই নাম্বারে কল করুন।